করোনার ছোবলে প্রায় অচল বিশ্ব সচল হয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঝুঁকির মাঝে আমাদের সন্তানদের ক্লাসে পাঠাতে চাই না। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। শিক্ষার্থীরা স্কুলে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবে। সবাই প্রমোশন পাবে। আমার ধারণা, এটি আপাতত একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও ক্ষতির পাল্লা ভারি হচ্ছে প্রতিদিন। সংকট উত্তরণে উত্তম বিকল্প আছে কি? জরুরি মুহূর্তে দূরদর্শী পদক্ষেপ মুক্তি দেবে চলমান ও পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খলা থেকে।
শিক্ষাজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান। মাসের পর মাস স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে পড়ালেখা লাটে উঠেছে, ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। শিশু শিক্ষার্থীদের দুরন্তপনা আর মানসিক বিকাশ আজ অবরুদ্ধ। কিন্তু গৃহবন্দি নেই কিশোররা। বেড়ে চলছে পাড়ায়-মহল্লায় কিশোর গ্যাং ও ইভটিজিংয়ের দৌরাত্ম্য নতুন বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত স্মার্টফোনের অতিব্যবহার আর অপব্যবহার, পাশাপাশি মাদক নেশায় জড়িয়ে নৈতিক অবক্ষয়ের খাদে স্বদেশ। হতাশা ভর করেছে সচেতন অভিভাবক মহলে। উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে শিক্ষার সমূহ ক্ষতি থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে রয়েছে অনলাইন ফোবিয়া, নানা অজুহাত আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। অধিকন্তু স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের ঘাটতি অনলাইন পরীক্ষা ও শ্রেণি কার্যক্রমের পথে বড় অন্তরায়।
১০০ শতাংশ অটোপাস আর লাখ লাখ A+ নিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে খুশির বন্যা বয়ে যেতে পারে। তবে পরীক্ষার টার্গেট শিক্ষার্থীকে পাঠে সম্পৃক্ত রাখে, তদারকি বাড়ে শিক্ষক ও অভিভাবকের। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শ্রেণিকক্ষে আধুনিক সুবিধা ও হাতে-কলমে শিক্ষার স্বল্পতা লক্ষণীয়। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনুধাবন এবং পাঠের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত পাঠে অভ্যস্ত হচ্ছে না। ছাত্র-শিক্ষকের সঠিক অনুপাত ও আকর্ষণীয় পাঠ উপস্থাপনের যোগ্য শিক্ষক তৈরি না করে প্রাথমিক শিক্ষায় পরীক্ষা তুলে নেয়ার সাম্প্রতিক পরিকল্পনা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেটিও আলোচনার দাবি রাখে। সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে না পেরে বিকল্প উপায় হিসেবে বছরে তিনটি সাময়িকসহ একাধিক সাপ্তাহিক/মাসিক পরীক্ষা চালু রয়েছে।
শিক্ষার্থীকে আমরা অতিমাত্রায় পরীক্ষার্থী বানিয়েছি। অথচ শিক্ষার মূল লক্ষ্য শিখনফল, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন। পরীক্ষা তা পরিমাপের ব্যবস্থামাত্র। রাষ্ট্র শিক্ষার মানের সূচকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক শ্রেণি কার্যক্রম ও পাঠ্যজ্ঞানের চেয়ে ফলাফলের পেছনে ছুটতে আগ্রহী। তারা শিক্ষার গুণগত মানের চেয়ে পরীক্ষা কিংবা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। ফলে শিক্ষার অদৃশ্য ক্ষতি বর্তমানে দীর্ঘায়িত হলেও তারা ততটা সোচ্চার নন। অধিকন্তু সার্টিফিকেটনির্ভর শিক্ষায় প্রকৃত জ্ঞানার্জন, সহপাঠক্রমিক দক্ষতা ও মূল্যবোধ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
অটোপাসের কল্যাণে ভর্তি পরীক্ষা হবে না- এমন অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করবে ‘ফেল’ মানের শিক্ষার্থী। এতে উচ্চশিক্ষার মান হবে আরও প্রশ্নবিদ্ধ। ভাবতে হবে কেন বিশ্বের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের একটিও নেই।
সংকটকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিকল্প বের করা সময়ের দাবি। আমি শ্রেণি কার্যক্রম ও পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা তুলে ধরতে আগ্রহী। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সমীপে আবেদন- এ ধরনের প্রস্তাবনা পাঠাতে উন্মুক্ত আহ্বান করা হোক। কার্যক্রম সহজ ও আকর্ষণীয় করতে জেলাভিত্তিক বাছাইকৃত রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠানো এবং জেলাভিত্তিক পুরস্কৃত করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে চূড়ান্ত নির্বাচিত প্রস্তাবনা বিশেষজ্ঞ কমিটি পরিমার্জন করবে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা থেকে উঠে আসতে পারে সর্বোত্তম বিকল্প। এতে জনমনে আস্থা সৃষ্টিসহ সমালোচনার পথ হবে রুদ্ধ।
প্রস্তাবনার ১ম ধাপ : শ্রেণি কার্যক্রম
নাগরিক সুবিধার প্রাচুর্যতায় শহরের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সরকারি কিংবা স্ব-উদ্যোগে অনলাইনে ক্লাস চলছে। উদ্যোগ না নেয়া অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও এটি সম্ভব। যেসব বিষয়ের ক্লাসে সরাসরি সাক্ষাতের বিকল্প নেই সেখানে অনলাইনের সঙ্গে সীমিত পরিসরে ইন-পারসন ক্লাসের মিশ্রণ থাকবে। অফলাইন টপিকগুলো অনুকূল পরিবেশের অপেক্ষায় শেষ সময়ের লেসন প্ল্যানে থাকবে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হবে।
পক্ষান্তরে গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাট, হাটবাজার, চা দোকান ও খেলার মাঠে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ছেলে-বুড়োর মাস্কহীন, ভয়হীন অবাধ বিচরণ। গ্রামে মাস্ক পরলে হাসির পাত্রে পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় করোনার কোনো বালাই নেই। তবে প্রাকৃতিকভাবে তাদের ইমিউনিটি সিস্টেম বেড়েছে।
এমতাবস্থায় শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের মাস্কসহ ট্রেনিং প্রদান করা হলে পরোক্ষভাবে ঘরে ঘরে হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি জানতে ও মানতে জনসাধারণ অভ্যস্ত হবে। করোনা প্রতিরোধে আরও একধাপ এগিয়ে যাব। আমরা ইতোমধ্যে দুই মাসের অধিক কওমি মাদ্রাসা খোলা রাখার সফল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। অতএব, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ঐচ্ছিক রেখে সীমিত পরিসরে বা ধাপে ধাপে শ্রেণি কার্যক্রমে অভ্যস্ত করা যায়। নিরাপদ দূরত্ব বাজায় রাখতে এক বা একাধিক নিয়ম রয়েছে- ১. সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস অথবা দৈনিক শ্রেণি সংখ্যা কমানো, ২. সেকশন বৃদ্ধি, ৩. জোড় অথবা বেজোড় রোল অনুসারে উপস্থিতি, ৪. শিফ্ট বৃদ্ধি।
প্রস্তাবনার ২য় ধাপ : পরীক্ষা
[ক] বার্ষিক পরীক্ষা
প্রথম পদ্ধতি : শহর এলাকায় অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা দেবে শিক্ষার্থী। অভিভাবক সব পরীক্ষা উপকরণ ও লিখিত নিয়মকানুন একসঙ্গে নেবেন। নিয়মকানুনের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক আহ্বান জুড়ে দেয়া যায় (যেমন- ১. রেজাল্টে প্লেস দেয়া হবে না। পরীক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য পাঠে সম্পৃক্ত রাখা, মনোযোগ বৃদ্ধি, নিজেকে যাচাই; ২. ঘরে বসেই পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের সততার শিক্ষা নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ। অসদুপায় অবলম্বন নিজের জীবনের ক্ষতি ডেকে আনে; ৩. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ পরিবার এবং বাবা-মা সন্তানের বড় শিক্ষক। সচেতন অভিভাবক অনৈতিক সুযোগ বন্ধে শিক্ষকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। ছাড় না দেয়ার ঘোষণা আগেই জানিয়ে সন্তানকে পাঠে মনোযোগী রাখেন)।
দ্বিতীয় পদ্ধতি : শহর এলাকায় অনলাইন পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা (একাধিক প্রক্রিয়া প্রচলিত)।
তৃতীয় পদ্ধতি : শহর এলাকায় প্রত্যেক শ্রেণিতে ক্ষুদ্র পরিসরে কেবল একটি করে পরীক্ষা নেয়া (পূর্ণমান ১০০)। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরো প্রতিষ্ঠানে একদিনে একটি শ্রেণি থাকলে আসন বিন্যাসে নিরাপদ দূরত্ব রাখা যাবে (গ্রহণযোগ্যতার ব্যাখ্যা- সরকারি স্কুল/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয় সমন্বয়ে ১০০ নম্বরের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার মূল্যায়ন/বাছাই সম্ভব হয়)। প্রয়োজনে প্রত্যেক শ্রেণিতে ১০০ এমসিকিউ, ১০০ সিকিউসহ দুটি পরীক্ষা দুই দিনে অথবা একই দিনে দুটি শ্রেণি অথবা শিফ্ট করে অথবা পরীক্ষা সংখ্যা বাড়ানো যাবে। গ্রামাঞ্চলের পরীক্ষা প্রথম বা তৃতীয় পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হবে।
[খ] পাবলিক/ভর্তি পরীক্ষা
বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মব্যস্ততা নেই। তৃতীয় পদ্ধতির আলোকে কেন্দ্র সংখ্যা বাড়িয়ে একই আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় পর্যায়ক্রমে এসএসসি, এইচএসসি, জেএসসি, পিইসি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হলে অর্থ, সময় ও শ্রম বাঁচবে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা জেলা সদর বা বিভাগীয় শহরে আয়োজন করা যায়। অন্যদিকে মেডিকেল/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হতে পারলে এইচএসসি পরীক্ষা হতে অসুবিধা কোথায়? কোনটি অপরিহার্য? এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ এখনও বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি (সমন্বিত/গুচ্ছ) প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিল রেখে তৃতীয় পদ্ধতিতে এইচএসসি পরীক্ষা হতে পারে। এইচএসসি রেজাল্টের ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হবে।
[গ] বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা
উচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মানতে সক্ষম। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার আসন বিন্যাসে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে রুটিনে আন্তঃবিভাগ সমন্বয় থাকবে, যাতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কক্ষও ব্যবহার করতে পারে।
শেষ কথা
বার্ষিক/পাবলিক পরীক্ষা তাড়াহুড়া না করে জানুয়ারি মাসে হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অবস্থার বিবেচনায় গ্রাম ও শহর বিপরীত নিয়ম অনুসরণ করবে। বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ছোটখাটো সমন্বয়ের প্রয়োজন হতে পারে। সারা বছর পর্যায়ক্রমে শিক্ষকদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম লেগে থাকে। শিক্ষার সিস্টেম লস কমাতে চলমান অবসর প্রশিক্ষণ কাজে লাগানোর উপযুক্ত সময়। শিশু শিক্ষার বৃহৎ স্বার্থে কেজি স্কুলকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। দক্ষতা সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্যোগকালে প্রশিক্ষণ ভাতায় নন-এমপিও শিক্ষকসহ সবাই উপকৃত হবেন। কোনো ফর্মুলা যুক্তিযুক্ত না হলে অনুকূল পরিবেশে প্রতিষ্ঠান খুলবে। সেক্ষেত্রেও অটো প্রমোশন নয়। খোলার শুরুতেও ক্ষুদ্র পরিসরে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া যায়। পরবর্তী সেশনে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ নষ্ট হলেও শিক্ষার্থীরা পাঠ সম্পৃক্ত থাকবে। নতুন বই যথারীতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে প্রদান করা যায়। এতে অন্ততপক্ষে সহজ বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা নিজ দায়িত্বে পড়ার সুযোগ পাবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আমরা যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখব- এই হোক আজকের অঙ্গীকার।
চৌধুরী মো. মহিউদ্দিন মান্নান : অধ্যক্ষ, সেন্ট্রাল পাবলিক কলেজ, চট্টগ্রাম
Leave a Reply