বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হয় বা ফার্মেসি বিষয়টি পড়ানো হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক কোর্স পদ্ধতি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টার ধরে হিসাব করলে প্রতিবছর প্রায় ছয় হাজার ফার্মাসিস্ট পাস করে বের হন।
এখন পর্যন্ত ফার্মাসিস্টদের চাকরির ক্ষেত্র শুধু ওষুধ-শিল্পকারখানা বিধায় গড়ে দু’শর বেশি চাকরির পদ সৃষ্টি হয় না। তাহলে এসব নবীন ফার্মাসিস্ট কোথায় যাবেন? তাদের চাকরির ক্ষেত্র কোথায়? নবীন ফার্মাসিস্টদের কাজের বৃহত্তর ক্ষেত্র সৃষ্টির জন্য দরকার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
তাই আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, বিশেষ করে নবীন ফার্মাসিস্টদের চাকরির ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য আমরা সরকারের কাছে কিছু দাবি জানাতে চাই। আমাদের দাবিগুলো নিম্নরূপ:
১. পদোন্নতির সুবিধা রেখে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক ফার্মেসিকে ‘ক্যাডার বিষয়’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। পদের নাম হবে ‘ফার্মাসিউটিক্যাল অফিসার’ অথবা ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ পদে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাবেন।
২. বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর, সেনাবাহিনী, ব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ‘Medical Corps’-এর অনুরূপ ‘Pharmaceutical Corps’ খুলতে হবে।
৩. সারা দেশে হসপিটাল ও কমিউনিটি ফার্মেসি চালু করতে হবে এবং এসব ফার্মেসিতে ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট বা গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগদানের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য ‘The Pharmacy Practice Act’ প্রণয়ন করতে হবে।
৪. ‘ড্রাগ ও থেরাপিউটিক কমিটি’ গঠন করে হাসপাতাল ও ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনায় ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫. ফার্মেসি একটি পেশাগত বিষয় এবং ওষুধ মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িত বিধায় এ পেশা ও পেশাজীবীদের সম্মান রক্ষার্থে যেসব ছাত্রছাত্রী ফার্মেসি পড়তে ইচ্ছুক, তাদের জন্য মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার অনুরূপ একটি ‘কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার ক্ষমতা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলকে (পিসিবি) দিতে হবে। সেই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীরা তাদের মেরিট (মেধাক্রম) অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হবেন।
পাঁচ দফা দাবি আদায়ে করণীয়
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মডেল ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ তথা দেশে হসপিটাল ফার্মেসি চালু করার জন্য আমাদের কিছু যুক্তিসংগত ও বাস্তবধর্মী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আমি নিচে কিছু কর্মসূচির কথা তুলে ধরছি-
১. হসপিটাল ফার্মেসি বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি গঠন করা। দেশে হসপিটাল ফার্মেসি ব্যবস্থা চালু করতে হলে একটি হসপিটাল ফার্মেসি বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি গঠন করা এবং কমিটির কার্যপরিধি নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। হসপিটাল ফার্মেসি বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি গঠন করার লক্ষ্যে আমি নিম্নরূপ প্রস্তাব করছি-
ক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন এ কমিটির আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব এ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
খ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান এ কমিটির সদস্য হবেন।
গ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা এ কমিটির সদস্য হবেন। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকরাও এ কমিটির সদস্য হবেন।
ঘ. বিপিএস এবং পিজিএর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা এ কমিটির সদস্য হবেন।
ঙ. ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক ও পরিচালকরা এ কমিটির সদস্য হবেন।
চ. ফার্মেসি কাউন্সিলের সদস্যরা এ কমিটির সদস্য হবেন।
ছ. টপ টেন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের এমডি বা জিএম পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এ কমিটির সদস্য হবেন।
জ. ফার্মেসি অ্যালামনাই সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা এ কমিটির সদস্য হবেন।
ঝ. বিসিএস ক্যাডার হিসেবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত সিনিয়র ফার্মাসিস্ট (প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী সচিব পদকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে) এ কমিটির সদস্য হবেন।
কমিটির কার্যপরিধি : কমিটি বিভিন্ন সময়ে সভা ডেকে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ হসপিটাল ফার্মেসি চালু করার ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলবেন। কমিটি নতুন সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। কমিটি সাব-কমিটি গঠন করতে পারবে।
২. The Pharmacy Practice Act প্রণয়নের জন্য স্বতন্ত্র উপকমিটি গঠন করা। দেশে হসপিটাল ফার্মেসি ব্যবস্থা চালু করতে হলে একটি উপযুক্ত আইনি কাঠামোর প্রয়োজন হবে। সেই লক্ষ্যে The Pharmacy Practice Act প্রণয়ন করার জন্য একটি স্বতন্ত্র উপকমিটি গঠন করা অত্যন্ত দরকার। সৌভাগ্যবশত আমাদের অনেক সিনিয়র ফার্মাসিস্ট দেশে-বিদেশে ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে কাজ করেছেন এবং তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ।
আমি নিম্নলিখিত সিনিয়র ফার্মাসিস্ট নিয়ে এ সাব-কমিটি গঠনের প্রস্তাব করছি- ক. প্রফেসর ফিরোজ উদ্দিন আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; খ. প্রফেসর বেলায়েত হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ; গ. মি. ইশতিয়াক আহমেদ, অ্যারিস্টোফার্মা; ঘ. প্রফেসর ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তারা সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবেন এবং The Pharmacy Practice Act আইনের খসড়া প্রণয়ন করবেন এবং মূল কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে হস্তান্তর করবে।
হসপিটাল ফার্মেসি বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি সময়ে সময়ে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, মিছিলের আয়োজন করবে এবং হসপিটাল ফার্মেসি বাস্তবায়ন করতে আরও যা যা কর্মসূচি নেয়া দরকার মনে করবে, সেসব কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
ড. মো. শাহ এমরান : অধ্যাপক, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমেস্ট্রি বিভাগ, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; কনভেনার, দ্য ফার্মেসি গিল্ড অব বাংলাদেশ
Leave a Reply