অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ভারতের সঙ্গে তুলনা করি। এটি শুধু প্রতিবেশী বলে নয়।
প্রতিবেশী দেশ আরও আছে। কিন্তু আর্থসামাজিক দিক থেকে ভারতের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য আছে। ভারত আগেই মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। আমরাও মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি। উন্নয়নের পাশাপাশি ভারতে ধনবৈষম্য প্রবল। বাংলাদেশেও ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমরা একে অপরকে সহায়তা করছি। ভারত বলে রেখেছে, তারা টিকা তৈরি করলে আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বও করোনা মোকাবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
অন্তত গণমাধ্যমে নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে আমরা সেই বার্তাই পাচ্ছি। এসব খবর নাগরিক হিসেবে আমাদের আশ্বস্ত করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের চিন্তাচেতনায় বিস্তর ফারাকও লক্ষ করি।
২৪ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টার-এ প্রথম পাতায় দুই কলামে প্রকাশিত খবরটি দেখে বড় ধাক্কা খেলাম। শিরোনাম ছিল: govt. allowances: ministers to get more for travels. সরকারি ভাতা: ভ্রমণের জন্য মন্ত্রীরা আরও বেশি পাচ্ছেন।
প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছ, যখন সারা বিশ্বের দেশগুলো কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে ব্যয়সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়েছে, বাংলাদেশ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের ভ্রমণ ভাতা বাড়িয়েছে ৯৩ লাখ টাকা।
গত ২৫ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে উপসচিব সাইদুর রহমানের সই করা এক চিঠিতে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে মন্ত্রীদের ভ্রমণ ভাতা বাবদ ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে কর্মকর্তাদের কেউ এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে ডেইলি স্টার প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তিনি চিঠির স্বাক্ষরদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। চিঠিতে যিনিই সই দিন না কেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এর দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাঁর নির্দেশেই এ চিঠি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠানো হয়েছে। আবার স্বাক্ষরদাতা বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট ডেস্ক কর্মকর্তাকে অর্থাৎ যিনি চিঠিটি তৈরি করেছেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে বলেন। ওই কর্মকর্তার জবাব হলো মার্চে বাজেটের বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। করোনা মহামারি এতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, সেটি তখন ধারণা করা যায়নি।
কিন্তু চিঠিটি পাঠানো হয়েছে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে। সাত মাস ধরে করোনার প্রাদুর্ভাবে জনজীবন প্রায় বিপন্ন। অর্থনীতি সচল রাখতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। ইতিমধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পসহ অনেক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আবার অনেক খাত এখনো বিপন্ন দশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে শুরু থেকে বিশৃঙ্খল ও নাজুক অবস্থা চলছিল। অনেক স্থানেই চিকিৎসার ন্যূনতম অবকাঠামো ও সরঞ্জাম নেই। লোকবলের ঘাটতি আছে। অনেক সাধারণ হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করায় অন্যান্য চিকিৎসা ব্যাহত হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীদের ভ্রমণ ভাতা বাড়ানোর চিঠিটি জনগণের সঙ্গে পরিহাস বলেই মনে হয়। এ ব্যাপারে শুক্রবার টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় আমরা জাতীয় দুর্যোগের মধ্যে আছি। এ সময়ে আশা করেছিলাম, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মন্ত্রীরা ভ্রমণ ভাতা নেবেন না। মন্ত্রীদের ভ্রমণ ভাতা বাড়ানো নৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়ে অগ্রহণযোগ্য। আমাদের এখানে ভ্রমণ ভাতাকে বাড়তি আয় হিসেবে দেখা হয়, যা সমীচীন নয়। যেখানে ভারতসহ অনেক দেশই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিদের বেতন–ভাতা কমিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে মন্ত্রীদের ভ্রমণ ভাতা বাড়ানো বা জনগণের ওপর বাড়তি কর চাপানো একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে।
যখন বাংলাদেশে মন্ত্রীদের ভ্রমণ ভাতা বাড়ানোর চিঠি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বিলি করা হলো তখন ভারতের একটি খবর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১৫ সেপ্টেম্বর এমপিদের বেতন–ভাতা ও পেনশন (সংশোধনী) বিল-২০২০ সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দিয়েছে ভারতীয় রাজ্যসভা। এর আগে লোকসভায় বিলটি পাস হয়। গত এপ্রিলেই দেশটির রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের বেতন-ভাতা ৩০ শতাংশ কমানো নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ১ এপ্রিল থেকে তা কার্যকরও হয়ে আসছে। করোনার কারণে এত দিন পার্লামেন্ট বন্ধ ছিল। পার্লামেন্ট অধিবেশন চালু হওয়ার পর সেই অধ্যাদেশই আইনে পরিণত হলো। বিলে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯–জনিত জরুরি পরিস্থিতি সামলাতে এমপিদের ৩০ শতাংশ বেতন কমানো হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী লোকসভায় বলেছেন, সাংসদদের বেতন কর্তন করে কত টাকা সাশ্রয় হবে সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ভালো কাজ ঘর থেকেই শুরু করা উচিত। বিরোধী দলের সাংসদেরাও বেতন–ভাতা কমানোর প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। ফলে বিলটি সর্বসম্মতি–ক্রমে পাস হয়। তবে বিরোধী দলের সাংসদেরা করোনা– কালে নতুন পার্লামেন্টে ভবন নির্মাণসহ ২০ হাজার কোটি টাকার ভিআইপি প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিসহ সাংসদদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে সব দলকে সব সময় একমত হতে দেখেছি। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা কমানো বিষয়ে তাঁরা এক হয়েছেন এ রকম কোনো নজির নেই। করোনাকালেও মন্ত্রী-সাংসদদের বেতন-ভাতা বহাল আছে। জাসদ সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তিন মাসের জন্য সাংসদদের বেতন–ভাতা সরকারি ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সাংসদদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। কেউ আগ্রহ দেখাননি। অর্থাৎ তাঁরা কেউ নিজেদের বেতন–ভাতা দিয়ে বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করতে রাজি নন। শুক্রবার হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ‘তিন মাস আগেই আমি প্রস্তাবটি দিয়েছিলাম। এমনকি স্পিকারের সঙ্গেও কথা বলেছি। কোনো সাড়া পাইনি। তিন মাসের বেতন হাতে এসেছে। অন্যরা না দিলেও আমাদের দলের দুজন সাংসদ ত্রাণ তহবিলে এটি জমা দেব।’
সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনসহ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্যসংখ্যা ৩৫০ (বর্তমানে কয়েকটি আসন শূন্য)। দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সব সাংসদই ধনী এবং বেতন–ভাতার ওপর তাঁরা নির্ভরশীলও নন। তারপরও বেতন–ভাতা কমাতে বা বিপন্ন মানুষের সহায়তায় গঠিত তহবিলে নিজেদের বেতন-ভাতার কোনো অংশ দিতে রাজি নন। ভারতের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের চিন্তাচেতনায় এটাই মৌলিক ফারাক।
করোনা মোকাবিলায় ভারতে মন্ত্রী–সাংসদেরা ৩০ শতাংশ বেতন–ভাতা কমিয়ে নিয়েছেন। আর আমাদের এখানে সরকার মন্ত্রীদের ভ্রমণ ভাতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন হলো এই বর্ধিত ভ্রমণ ভাতা মন্ত্রীরা কী কাজে ব্যয় করবেন? কোথায় খরচ করবেন? করোনা না থাকলে তাঁরা বিদেশে আনন্দ ভ্রমণে যেতে পারতেন। করোনার জন্য সেটিও বন্ধ। তারপরও তাঁদের বর্ধিত ভ্রমণ ভাতা প্রয়োজন হলো কেন?
উল্লেখ করা প্রয়োজন, অর্থনৈতিকভাবে অনেক দুর্বল হলেও আমাদের সাংসদেরা বেতন–ভাতার দিক দিয়ে ভারত থেকে খুব পিছিয়ে নেই। ভারতের সাংসদেরা মাসে ১ লাখ রুপি বেতন ও ৭০ হাজার রুপি ভাতা পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশেও সাংসদেরা বেতন-ভাতা সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকার মতো পান।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
Leave a Reply