‘মা, টিভি বন্ধ কোরো না’ বলে সাত বছরের যে শিশুটি বাবার সঙ্গে বাড়ির কাছের মসজিদে গিয়েছিল, সেই জুবায়ের তার মায়ের কাছে আর ফেরেনি। নারায়ণগঞ্জের মসজিদের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে অন্য আরও অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে তারও মৃত্যু হয়েছে। মসজিদের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ নির্ধারণে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হয়তো আরও হবে। কিন্তু একটি বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট যে গ্যাসলাইনে ছিদ্র থাকার কারণে বেশ কয়েক দিন ধরেই সেখানে বাতাস দাহ্য হয়ে পড়েছিল। গ্যাস কোম্পানির কয়েকজন মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী ও কর্মী বরখাস্ত হয়েছেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় ত্রুটির জন্য দায়ী বড় কর্তাদের কিছু হয়নি। যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠানটি চলে, তাঁরাও কেউ কোনো দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা, মসজিদ কমিটি এবং স্থানীয় লোকজন সবাই এ অভিন্ন কারণটির কথা বলেছেন।
কর্তৃপক্ষের অবহেলার জন্য চার বছরের শিশু জিহাদের মৃত্যুর কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ঢাকার শাহজাহানপুরে রেলওয়ের মাঠে একটি পরিত্যক্ত পানির পাইপে পড়ে গিয়ে জিহাদের মৃত্যু হয়েছিল। পানির পাইপের মুখটি খোলা থাকার কারণে রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জিহাদের বাবা মামলা করলে সেই মামলায় বিশেষ জজের আদালত রেলের তিনজন এবং একজন ঠিকাদারের ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করেন। কিন্তু হাইকোর্টে সেই রায় নাকচ হয়ে যায় এবং সবাই খালাস পেয়ে যান।
হাইকোর্টে রায় খারিজ হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয় রেলওয়ে ম্যানুয়ালে ওই পরিত্যক্ত পাইপের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দণ্ডিত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের নয়। তঁাদের যে আইনে সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেটিও ঠিক ছিল না বলে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ে ঘটনাটিকে অবহেলাজনিত হত্যা নয়, বরং দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির সুনির্দিষ্ট আইন কতটা প্রয়োজন ও জরুরি, এই মামলা তার একটি দুর্ভাগ্যজনক প্রতীক।
ওই বছরেরই ১১ এপ্রিলএক প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকার মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় রাত তিনটার সময় গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণে আগুন লাগার খবর জানানোর পর তিতাস গ্যাসের কর্তব্যরত কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘মানুষ তো আর আগুনে পুড়ে মরেনি। এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’
এর আগে, সে বছরেই ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে একই পরিবারের চার সদস্য মারা যান। গত কয়েক বছরের সংবাদপত্রগুলো খুঁজলে এ রকম আরও অনেক ঘটনার খবর মিলবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়িত্বহীনতার পরিণতিতে অবহেলাজনিত হত্যা ও জখমের ঘটনা ঘটলেও খবরে তা আসে দুর্ঘটনা হিসেবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতেও কখনো কখনো আইনগত প্রতিকার চাওয়ার কেউ থাকে না। যদি কেউ থাকেও, তাহলে দেখা যায় মামলা করার পর তদবিরের অভাবে বছরের পর বছর সেগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় থেকে যায়। প্রচলিত ফৌজদারি আইনে এ ধরনের মামলার বিচারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি শিশু জিহাদের মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে উঠে এসেছে। ভুক্তভোগীর পরিবারগুলোর অসহায়ত্বের অবসানে তাই এমন আইনগত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা সহজেই বিচার এবং ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।
বছর বছর গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় সেবার মান উন্নয়নের প্রশ্নটিকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রমাণ মেলে না। অথচ তার পরিণতি হচ্ছে বেশি দামে বেশি মৃত্যু কেনা। নারায়ণগঞ্জে এই মসজিদের ক্ষেত্রে সরকারি এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার পরিণতি ৩১ জন মানুষের প্রাণহানি। নিশ্চিত অবহেলার কারণেই এসব মৃত্যু ঘটেছে। এ অবহেলা অপরাধ তো বটেই, এর অন্য আরেকটি দিক হচ্ছে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর ক্ষতির প্রশ্ন। এসব পরিবারের কেউ হারিয়েছেন একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে, কেউ হারিয়েছেন অপার সম্ভাবনাময় তরুণ সন্তানকে। কিন্তু তাঁদের ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়াও অস্পষ্ট ও জটিল।
বাংলাদেশ গ্যাস আইন ২০১০ এবং তিতাসের গ্যাস সংযোগ নীতিমালায় গ্রাহকদের জরিমানাসহ নানা ধরনের সাজার কথা আছে। কিন্তু দুটির কোনোটিতেই গ্রাহকের ক্ষতিপূরণে কোম্পানির দায়দায়িত্বের বিষয়ে কিছু নেই। অর্থাৎ অপরাধ হিসেবে ফৌজদারি বিচার কিংবা ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি বিচার কোনোটিরই কোনো পথ খোলা নেই।
এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। অবহেলাজনিত মৃত্যু বা হত্যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দায় নির্ধারণে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় ধরনের আইন প্রণয়ন করা এবং তা কার্যকর করার প্রসঙ্গটিকেই এখন অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
Leave a Reply