গত মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর) ছিল আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, আমাদের সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশ। যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, বিশেষ করে এনজিও ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ এ নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছে। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এর মধ্যে রাশেদা কে চৌধুরী একজন। তিনিসহ অনেকেই এই পরিসংখ্যান প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেছেন। সরকারের তথ্যের এই বিশ্বাসযোগ্যতার বড় ঘাটতি রয়েছে। সরকার বিভিন্ন সময় তথ্য দেয়, সেটা আসলে কতটা প্রুফ করতে পারে? সেই দাবি উন্নয়ন নিয়ে হতে পারে, আমাদের শিক্ষার হার নিয়েও হতে পারে, ডিজিলাইজেশন নিয়েও হতে পারে।
সাক্ষরতা বিষয় নিয়ে একটা সমস্যা আছে। সমস্যা হলো- আমাদের সাক্ষরতার সংজ্ঞা কী হবে। এটা কি একটা মকশো করে ক খ গ ঘ দিয়ে নামটা লিখতে পারে। অথবা অক্ষর দিয়ে নামটা শিখিয়ে দিল। যাকে শেখানো হলো, সে তার নামটা লিখতে পারল যেমন- করিম, সে করিম লিখল; রাবেয়া, সে রাবেয়া লিখল। এই লিখতে পারাটাই কি সাক্ষরতা! এটা সাক্ষরতার মধ্যে পড়ে না। সাক্ষরতায় তিনটি ‘আর’ অর্জন করতে হয়। তিন ‘আর’ হলো- রিডিং, রাইটিং এবং অন্যটা অ্যারিথমেটিক। যে পড়তে পারবে, লিখতে পারবে এবং অঙ্ক করতে পারবে। এই তিন ‘আর’-এর সঙ্গে চতুর্থ একটা আর আছে, সেটা হলো রিলেট করা। সে পড়তে পারল, লিখতে পারল এবং অঙ্ক করতে পারল। এগুলো জীবনের সঙ্গে রিলেট করতে পারে কিনা, যদি পারে তবেই না সাক্ষরতা। বাস্তব জীবনে যদি কাজে লাগতে পারে এবং জীবননির্ভর হয়, তা হলেই তাকে সাক্ষরতা বলা যায়।
সাক্ষরতার সংজ্ঞাটা আসলে কী, সেদিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তিনি ভালো করে বলতে পারেননি। তিনি দাবি করেছেন, প্রাইমারি পর্যন্ত শিক্ষাকে তারা সাক্ষরতা বলতে চান। সেটা যদি আমরা ধরি, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত হয়, তা হলে ৭৫ শতাংশ হবে না। অনেকে নিচে হতে পারে। নাম লিখতে পারে, এমন হতে পারে। এমন সংখ্যাই বেশি।
সাক্ষরতা আমাদের একশ ভাগ হলো, সেটা প্রধান ব্যাপার নয়। এটার গুণগত মান অর্জন করতে পারলাম কিনা। পঞ্চম শ্রেণি, অষ্টম শ্রেণি, এসএসসি ও এইচএসসি পাস হলো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ও পাস হলো; কিন্তু কোয়ালিটি এডুকেশন হলো কিনা এটাই মূল বিষয়।
শিক্ষার কী দাঁড়াল। পুরো পৃথিবীতে কিন্তু শিক্ষার হার একশ পারসেন্ট, এটা বলা হয় না। বলা হয় গুণগত শিক্ষার হার আমাদের কত হলো। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার সময় হিসাব করা হয়, শিক্ষানীতিতে আছে। এই বিশেষ দক্ষতা অর্জন করবে। এই জ্ঞান অর্জন করতে পারবে এবং এই বিষয়গুলোর ওপর যদি পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা হলে পাস করতে পারবে; কিন্তু আমরা দেখেছি যে, তার ভাষার ব্যাপারে চিন্তা করার ক্ষেত্রে, অঙ্ক করার ক্ষেত্রে বলার ব্যাপারে এই দক্ষতা অর্জন হয় না। এই যে শিক্ষার্থী অর্জন করতে পারে না। ক্লাস টেনে পারে না, এসএসসিতে পারে না, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা গ্র্যাজুয়েট হচ্ছেন তাদের মধ্যেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। তারা যখন চাকরির বাজারে যাচ্ছেন, তাদের দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না। অনেক রকমের ঘাটতি দেখা যায়। এটা কেন হয়েছে- প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তর হচ্ছে- সবশেষে শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয় ২০১০ সালে, আজ প্রায় ১০ বছর পার হয়ে গেছে। সে শিক্ষানীতির কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষানীতির বড় একটা ব্যাপার ছিল, প্রাথমিক শিক্ষার সংজ্ঞা কী হবে। শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- ক্লাস ওয়ান থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে প্রাথমিক শিক্ষা। আজ পর্যন্ত কিন্তু আমরা প্রাথমিক শিক্ষার বিভাজনটা করতে পারিনি। এখনো ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয়েছে।
কেন রেখে দিয়েছি- আমি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছেন, আমাদের সক্ষমতা নেই। প্রাইমারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া, সে শিক্ষক তৈরি হয়নি এখনো। বিদ্যালয়ের বিল্ডিংয়ের অবকাঠামো নেই। আমাদের কারিকুলাম তৈরি হয়নি। আমরা ভেতর থেকে জানি যতটা না অবকাঠামো, তার চেয়ে ঘাটতি রয়েছে মানসিকতায়। দুই মন্ত্রণালয়- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং আরেকটি হলো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় যারা মন্ত্রী আছেন, বিশেষ করে আমলারা তারা ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণি ছাড়তে চান না।তাদের সঙ্গে রাখতে চান। কারণ হাত ছাড়া করলে তাদের ক্ষমতা কমে যাবে।
এই দুই মন্ত্রণালয়ের যে দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক, মানসিক ও মাইনসেট- এসব কারণে এতগুলো বছর পরও আমরা করতে পারিনি অথচ পৃথিবীজুড়ে কিন্তু পঞ্চম পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নেই। এমনকি জাতিসংঘের নীতিতেও এটা নেই; আছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা। আমরা শুধু শিক্ষানীতিতে বলেছি; কিন্তু কোনো কাজ করতে পারিনি। আমি মনে করি এটা সবচেয়ে জরুরি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেব। আমি জার্মানিতে দেখেছি, তারা পুরোটা গুরুত্ব দেয় প্রাথমিক শিক্ষাকে এবং এক থেকে বারো ক্লাস পর্যন্ত তারা প্রাথমিক শিক্ষা বানিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা বিভিন্ন পরীক্ষা নেয়। জার্মানিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে ছাত্রছাত্রীদের মেধার ভিত্তিতে চার ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়। এ ছাড়া বিশেষ কিছু বিদ্যালয় আছে অসুস্থ এবং খুব খারাপ ছাত্রছাত্রীদের জন্য, যাদের মাথায় কিছু ঢোকে না। এই মেধার বিচার করা হয় ছাত্রছাত্রীদের জার্মান, গণিত ও গার্হস্থ্য এবং সাধারণ শিক্ষা বিষয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে প্রাপ্ত গ্রেডের ভিত্তিতে। কোনো সুপারিশ কোনো ছাত্রছাত্রীকে এক স্তর থেকে অন্য স্তরে স্থানান্তর করা হয় না । মেধার ভিত্তিতে এই ভাগের অর্থই হলো, ভালো এবং খারাপ একসঙ্গে থাকলে উভয়েরই পাঠ গ্রহণে সমস্যা হয়। আপনি যত বড় টাকাওয়ালা হোন না কেন, ইচ্ছামতো ভর্তি করাতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে টাকা হলেই সব হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য নয়। আমরা সবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা রেখেছি। আমাদের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সুযোগ না পায়, তা হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেডিক্যাল কলেজের ক্ষেত্রেও তাই। ১২ ক্লাস পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যালে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে কিনা, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সে রকম একটা শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া জরুরি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ২৪৯টি। ৮৫৭টি কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ৪ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। তা ছাড়া ১৪৫টি কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পাঠদান করা হয়। এর মধ্যে বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস, ইতিহাস ও সমাজকল্যাণ। আমাদের কি ইসলামের ইতিহাস পড়ার দরকার আছে? সবকিছুর মাঝে ইতিহাস রাখা; কিন্তু এই যে চার-পাঁচ বছরে কী অর্জন করে। আমাদের হওয়া উচিত জীবনবিমুখ কারিকুলাম ও শিক্ষকদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন। কাজেই সেক্যুলার, আধুনিক, গণতন্ত্র, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র যদি চাই; তা হলে আমাদের প্রধান যে জায়গায় হাত দিতে হবে সেটা হলো- শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন দ্রুত করতে হবে। আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি দরকার। না হলে এমএ পাস করে কিন্তু সে ভূতে বিশ্বাসী হবে। বুয়েট থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার হবে; দেখা যাবে সে হাতের ভেতর মাদুলি ঢুকিয়ে রেখেছে। এই গ্র্যাজুয়েট দিয়ে হবে না। কাজেই এটা দিয়ে হবে না। এটা আসলে শিক্ষার মূল জায়গা না।
মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, বাংলা মিডিয়াম, ইংরেজি মিডিয়াম; নিচের দিকে ১১ রকমের শিক্ষা রয়েছে। আমাদের সমন্বয় নেই, সমন্বয় দরকার। কারিকুলাম দরকার। আমাদের শিক্ষানীতির কিছু ধারা, বিশেষ করে শিক্ষা কারিকুলাম ধারা প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড হেফাজতের মতো মোল্লা যারা, তাদের চাপে পড়ে পরিবর্তন করেছে। অনেকের কবিতা তারা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে’… জীবনান্দন দাশের কবিতা দেওয়া যাবে না কারণ হিন্দু ধর্মের কথা, জন্মান্তবাদ। ইসলাম ধর্মে তো আর ফিরে আসা যায় না, তারা পরকালে বেহেশতে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বাদ দিতে হবে কারণ তিনি হিন্দু কবি। এ রকম অনেক প্রস্তাব তারা দিয়েছে। হুমায়ুন আজাদের গল্প বাদ দিয়েছে। শিক্ষার মতো আধুনিক প্রগতিশীল বিষয়ে মোল্লারা যদি আমাদের চাপ দিয়ে মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, তা হলে কিন্তু আমাদের সেই জায়গাটা হবে না। প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারবে না। কাজেই স্বাধীনতার ৫০ বছরে প্রধান কাজ হওয়া উচিত জঙ্গিবাদ, মোল্লাতন্ত্র, ধর্মান্ধবাদ সবকিছু থেকে মুক্ত একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা এবং এটা হতে হবে ক্লাস ওয়ান থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক ঘোষণা করতে হবে। সবচেয়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে প্রাথমিক পর্যায়ে।
সাধারণত উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের তেমন পার্থক্য নেই। অনেক সময় দেখি প্রাথমিকের শিক্ষকের বেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চেয়ে বেশি। আমাদের দেশে এমন যদি করা হয়, তা হলে মেধাবীরাই প্রাথমিক শিক্ষক হবেন এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের ভিত্তি ভালো হবে। যে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো, তারাই সব জায়গায় ভালো করে। সবচেয়ে বেশি বেতন দিয়ে যোগ্য শিক্ষককে নিয়োগ দিতে হবে। আমরা যে শিক্ষানীতিতে চলছি, সে শিক্ষানীতি দিয়ে আমাদের দেশ চলবে না। আমাদের একটা আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রয়োজন।
রোবায়েত ফেরদৌস : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply