অবশেষে আরব ঐক্যের দেখা মিলেছে। যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্মজুড়ে ফিলিস্তিনিরা স্বপ্ন দেখেছে, সম্মিলিত আরব বাহিনী সীমান্ত পেরিয়ে এসে তাদের মুক্ত করবে। নির্বাসিত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক রামজি বারুদ লিখেছেন, ‘রাতে শরণার্থী শিবিরে কারফিউয়ের মধ্যে আমি ও আমার বন্ধুরা ঘুমাতে যেতাম এই আশা নিয়ে যে সম্মিলিত আরব বাহিনী রাতের যেকোনো মুহূর্তে সীমান্ত পেরোবে।’ অনেক প্রতিবাদীর লাশ পড়েছে, অনেক ফিলিস্তিনি জমিতে ইসরায়েলি বসতি কায়েম হয়েছে কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্য হয়নি। আরবের রাজা–বাদশাহ–আমির–সুলতান আর জেনারেলরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন স্বজাতির পক্ষে নয়, ইসরায়েলের পক্ষে। মিসর তো আগেভাগেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিয়েছিল। এখন আরব আমিরাতের ইসরায়েলের মিত্র হওয়ার ঘোষণার এক মাসের মাথায় বাহরাইনও মৈত্রীর মিছিলে শামিল হয়েছে। মুসলমানদের পবিত্র দিন শুক্রবারে বাহরাইন এই ঘোষণা দেয়।
অনেকে অবাক হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই ছিল অবধারিত। এতে লাভ আরব, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র সবারই। মার্কিন দূতিয়ালির মাধ্যমে আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের এত দিনের যোগাযোগকে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক হিসেবে ঘোষণা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ, কৌশলগত কারণে তাদের শত্রু ইসরায়েল নয়, তাদের শত্রু হলো ইরান। ইসরায়েলি গোয়েন্দামন্ত্রী এলি কোহেন গত সপ্তাহে বিষয়টা সুন্দরভাবে পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত ইসরায়েল–আরব সম্পর্কে কোনো বাধা না।…আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধন আরও নিবিড় করবে, কারণ তারা বিশ্বাস করে মধ্যপ্রাচ্যের মূল হুমকি হলো ইরান।
বিষয়টা ইসরায়েল ভালোই বোঝে। ইসরায়েলি গোয়েন্দামন্ত্রীর মুখেই শুনুন: ‘আমাদের হুঁশিয়ার হওয়া উচিত যে গ্যাস ও তেলের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে; বাড়ছে প্রযুক্তির গুরুত্ব। সুতরাং সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্যান্যরা ইসরায়েলের সহযোগিতা পেতে আগ্রহী, এটা পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়।’
ফিলিস্তিনিদের ট্র্যাজিক জীবনে ক্ষীণ আশার রেখা একটিই। হামাসের ইরান প্রতিনিধি তেহরানে বসে সম্প্রতি বলেছেন, ইরান, তুর্কি ও কাতার জোটবদ্ধ হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি হামাস–হিজবুল্লাহ ও ফাতাহর মধ্যেও বৈঠক হচ্ছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে আরব ঐক্যের আগে জরুরি হলো ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন পক্ষের ভেতরকার ঐক্য। মধ্যপ্রাচ্যে পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক খেলা চূড়ান্ত পর্বের দিকে যাচ্ছে। সবাই পক্ষ বেছে নিচ্ছে। বাঁচতে হলে আধিপত্যের শক্তিগুলোর ঐক্যের বিরুদ্ধে নিপীড়িত ও তাদের বন্ধুদের ঐক্য ছাড়া কোনো পথ নেই। এই ঐক্যের মাঠকর্মটা করে রেখেছিলেন ইরানের বীর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। আর সে জন্যই আমেরিকান বোমা হামলায় জীবন দিতে হয় তাঁকে।
আরবের ইসরায়েলপন্থীদের মুখোশ খসে যাওয়া সেই দিক থেকে ভালো। শাসকেরা যাদের ব্যর্থ করে দিয়েছে, সেই সব আরব জনতা এবং বিশ্বের শান্তিবাদীদের সামনে নিরপেক্ষ থাকার আর সুযোগ রইল না। দিনের শেষ, এখন সমীকরণ দাঁড়াল এই: ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে হলে কেবল ইসরায়েলকে পরাস্ত করলেই চলছে না, পরাস্ত করতে হবে আরবের ইসরায়েলপন্থী শাসনব্যবস্থাকে। কাজটা কেবল সামরিক নয়, রাজনৈতিক। যুদ্ধটা তাই বাইরের সঙ্গে নয় কেবল, ঘরের শত্রু বিভীষণকে মোকাবিলা না করে বাইরের শত্রুকে কেউ কখনো মোকাবিলা করতে পারে না।
ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
Leave a Reply