গত ১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় নিউজ ম্যাগাজিন ‘দি আটলান্টিক’-এ ডেভিড গ্রাহাম একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধটির শিরোনাম Kanosha could cost trump election- অর্থাৎ কেনোসার ঘটনাবলির কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প! আগামী ৩ নভেম্বর সেখানে নির্বাচন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের সঙ্গে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেন্দ্র করে সেখানে উত্তেজনা যেভাবে বাড়ছে ও জাতিগত দ্বন্দ্ব যেভাবে এক স্টেট থেকে অন্য স্টেটে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সেই সঙ্গে ট্রাম্পের বেশকিছু উসকানিমূলক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নানা মহলে প্রশ্নের জন্ম হয়েছে যে, ট্রাম্প আদৌ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারবেন কিনা? আটলান্টিকের বিশ্লেষক গ্রাহাম কেনোসার ঘটনাবলিকে সামনে রেখেই মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প বিজয়ী নাও হতে পারেন! কেনোসা হচ্ছে উইসকনসিন রাজ্যের একটি ছোট্ট শহর। সেখানে জ্যাকব ব্ল্যাক নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে পুলিশ গুলি করে আহত করে গত ২৩ আগস্ট। ওই ঘটনায় ওই এলাকায় বর্ণবাদী দাঙ্গা শুরু হয়। দোকানপাট লুটপাট হয়।
শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়াদের হাতে এআর ১৫ রাইফেল নিয়ে শহর টহল দিতে দেখা যায়। পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় যখন শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়াদের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। এমনি এক পরিস্থিতিতে কেনোসাতে যখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল, তখন ট্রাম্প স্থানীয় মেয়র ও উইসকনসিনের গভর্নরের অনুরোধ উপেক্ষা করে ওই শহরে যান। এমনকি তিনি নিহত জ্যাকব ব্ল্যাকের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেও অস্বীকৃতি জানান।
শুধু তাই নয়, ১৭ বছরের শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়া কিলে রিটেন হাউজ, যাকে পুলিশ দ্বিতীয় আরেকটি হত্যাকা-ের জন্য গ্রেপ্তার করেছে, তার প্রতি ট্রাম্প নিজের সমর্থন ছুড়ে দিয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে এবং সেই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারদের সমর্থন, গুলিতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার নিন্দা না করা ও ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ আন্দোলনের সমালোচনা করা, সর্বোপরি কেনোসায় ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বকে উসকে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনায় ট্রাম্পের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দ্বন্দ্ব ও বিভেদ যত বৃদ্ধি পেয়েছে, অতীতে তেমনটা হয়নি কখনো। যুক্তরাষ্ট্রে এই জাতিগত দ্বন্দ্ব নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গত ১ সেপ্টেম্বর (এবড়ৎমব ঋষড়ুবফ ফবধঃয : যিধঃ’ং পযধহমবফ ১০০ ফধু’ং ষধঃবৎ)। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকা-ের ১০০ দিন পরও যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। গত ২৫ মে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড পুলিশ কর্তৃক নিহত হওয়ার পর পুরো যুক্তরাষ্ট্রেই এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। আর এর সর্বশেষ ঘটনা অরেগনে। এ ঘটনার জন্য বাইডেন দায়ী করেছেন ট্রাম্পকে। বলেছেন, ‘বেপরোয়াভাবে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন ট্রাম্প।’ ট্রাম্প নিজে পোর্টল্যান্ডে কৃষ্ণাঙ্গদের জমায়েতের বিরুদ্ধে পাল্টা জমায়েতের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর এজন্য পোর্টল্যান্ডের ডেমোক্রেটিক মেয়র টেড হোয়েলার দায়ী করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। এদিকে জনপ্রিয় নিউজ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট এক জনমত জরিপ প্রকাশ করেছে। জরিপে বলা হয়, ৫৩৮ জন ইলেকটোরাল কলেজের ৮৮ শতাংশ পেতে পারেন বাইডেন। ২৯ আগস্টের জরিপে দেখা যায়, জো বাইডেন পাবেন ইলেকটোরাল ভোটের ৩৪৭টি, আর ট্রাম্প পাবেন ১৯১টি। মোট ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে পেতে হবে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট। ৫০টি স্টেটের মাঝে কোনো কোনো স্টেটে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা বেশি। কোনোটাতে আবার কম। তবে সব জরিপের ফলাফলই যে শেষ পর্যন্ত ‘সত্য’ হয়, তা বলা যাবে না। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জনমত জরিপ শেষ পর্যন্ত সত্য হয়নি। ওই সময় জনমত জরিপে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ‘ইধঃঃষবমৎড়ঁহফ ংঃধঃবং’-এর (মোট ৬টি) ভোটেই ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাস ২৩১ বছরের, ১৭৮৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত (স্বাধীনতা ঘোষণা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই)। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৮৯-১৭৯৭)। তিনি ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী। জর্জ এডামসও ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির প্রার্থী (১৭৯৭-১৮০১)। কিন্তু তৃতীয় প্রেসিডেন্টের (থমাস জেফারসনের, ১৮০১-১৮০৯) শাসনামল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান পার্টি একসঙ্গে একক প্রার্থী হিসেবে চার টার্মে ক্ষমতায় ছিল। সপ্তম প্রেসিডেন্ট এডু জ্যাকসনের (১৮২৯-১৮৩৭) সময় থেকেই ডেমোক্র্যাট পার্টি আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। রিপাবলিকান পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন (১৬তম প্রেসিডেন্ট, ১৮৬১-১৮৬৫)। সেই থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দুটি বড় দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির মাঝে সীমাবদ্ধ। প্রথমদিকে অবশ্য তৃতীয় একটি পার্টি উইগ পার্টির অস্তিত্ব ছিল। উইগ পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন (৯ম, ১৮৪১)। যদিও নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারেননি। ট্রাম্প হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট।
প্রতিটি নির্বাচনের সময়ই কিছু কিছু ‘ইস্যু’ প্রাধান্য পায়, যা ভোটারদের প্রভাবিত করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ভোটাররা ভোট দেন। কিন্তু যিনি বিজয়ী হন, তিনি ওই স্টেটের প্রতিটি ইলেকটোরাল কলেজের সব কটি ভোট পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। যদিও এবার ‘ইস্যু’ আছে। বিশেষ করে বর্ণবাদ, শ্বেতাঙ্গ ‘সুপ্রিমেসি’, ১১.১ ভাগ বেকার সমস্যা, কোভিড-১৯ রোধে ব্যর্থতা, উৎপাদন খাতে ধস ও ব্যাপক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি তথা দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও ¯œায়ুযুদ্ধ-২ এর সূচনা- সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ ক্ষেত্রে ভোটাররা তাকে দ্বিতীয় টার্মের জন্য বেছে নেবেন কিনা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। জাতিগত বিদ্বেষ এবং এই বিদ্বেষকে উসকে দেওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্পের ভূমিকা তাকে বারবার বিতর্কিত করছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে পিউ রিসার্স সেন্টার একটি জনমত সমীক্ষা পরিচালনা করে। ভোটারদের কাছে তারা মতামত জানতে চায়। তাদের পরিচালিত জনমত সমীক্ষায় (১৩ আগস্ট ২০২০) দেখা যায়, শতকরা ৭৯ ভাগ ভোটার অর্থনীতিকে ‘অগ্রাধিকার’ দিয়েছে প্রথমে। এর পর ৬৮ ভাগ দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবাকে, ৬৪ ভাগ সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি নিয়োগকে, ৬২ ভাগ করোনা ভাইরাসকে, ৫৯ ভাগ ক্রাইমকে, ৫৭ ভাগ বৈদেশিক নীতিকে ইত্যাদি। এ থেকেই বোঝা যায়, ভোটারদের আগ্রহ কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন বা দিচ্ছেন, ভোটাররা সেদিকেই লক্ষ রাখবেন। ইতোমধ্যে আরও কিছু কিছু জনমত সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। জুনের ২৭ তারিখ নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের একটি যৌথ সমীক্ষা প্রকাশ করেছে ইয়াহু নিউজ। তাতে দেখা যায়, ইধঃঃষবমৎড়ঁহফ ঝঃধঃব-গুলোর মাঝে প্রায় সব কটিতেই জো বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। ইতোমধ্যে ডেমোক্র্যাট পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনে কমলা হারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করায় নির্বাচনী প্রচারণায় কিছুটা বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখার পালা, যার রক্তে জ্যামাইকান (বাবা) ও ভারতীয় রক্তের (মা) মিশ্রণ রয়েছে, তিনি নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত দার্শনিক নোয়াম চমস্ক্রি ঐরষষ.ঞঠ-তে এক সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধায় অভিমত দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে চলেছে (ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঈষবধৎরহম ঐড়ঁংব, ৩১ অঁমঁংঃ, ২০২০)। আর অধ্যাপক রিচার্ড উলফের মন্তব্য- ঞযব ংুংঃবস রং ভধরষরহম (ওই)। এ ধরনের মন্তব্য ও শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদন প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ঠিকমতো চলছে না। তাই নভেম্বরের নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply