দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। প্রতিদিনই পরিচিতজনের মৃত্যুসংবাদ। সংক্রমিত হওয়ার ভয়। প্রিয়জনকে নিয়ে শঙ্কা। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা। সবকিছুর পরও জীবন কিন্তু থেমে নেই।
সদ্য উদ্যাপিত হলো ঈদুল আজহা, কোরবানির ঈদ। এ দমবন্ধ পরিস্থিতিতে আগে উদ্যাপিত হয়েছে ঈদুল ফিতর আর বাংলা নববর্ষ। সবকিছুর পরও আমাদের থাকতে হবে চাঙা, মনকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ধরে রাখতে হবে মনোবল। একদিকে করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে সামাজিক রীতিনীতি, বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্নগুলো। বন্ধ সব স্কুল–কলেজ, ঈদেও নেই কোনো উৎসবের প্রতিধ্বনি—তারপরও ভালো থাকার কথা, মন চাঙা রাখার কথা বলতেই হচ্ছে। কারণ, পরিস্থিতি যত বিরূপ, মনের জোরের গুরুত্ব তত বেশি। এ বন্ধ্যা সময়ে যদি আমরা হতাশ হয়ে পড়ি, মনে যদি জন্ম নেয় হতাশা আর হাল ছেড়ে যদি অদৃষ্টের কাছেই নত হয়ে যাই, তবে পরিস্থিতি পরিবর্তন করার সুযোগ কমে আসবে। করোনার প্রকোপ, বন্যা সবকিছুকে ধারণ করেই নিজের ভেতরের জীবনী শক্তি বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
শত প্রতিকূলতায় মনোবল ঠিক রাখতে যা যা করা যেতে পারে
পরিস্থিতি বুঝতে শিখুন
বিরূপ পরিস্থিতির যৌক্তিক ব্যাখ্যা জানুন। মিথ বা গুজবে কান না দিয়ে কী-কেন-কীভাবে এ অবস্থার উত্তরণ হতে পারে তার বিজ্ঞানসম্মত ও যৌক্তিক ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করুন। এ জন্য তাড়াহুড়া করবেন না। একটু সময় নিন।
ইতিবাচকভাবে ভাবুন
চারপাশে শত খারাপ সংবাদের পাশে কিন্তু হাজারো সুসংবাদ আছে। সেসব সুসংবাদের সুবাতাসকে অবরুদ্ধ করবেন না। আশাব্যঞ্জক অভিজ্ঞতাগুলো বারবার অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিন। যেমন করোনাভাইরাস থেকে যাঁরা সুস্থ হয়েছেন, তাঁদের কথাগুলো আলোচনা করুন, বন্যায় যাঁরা ত্রাণ নিয়ে বন্যাপীড়িতদের পাশে গেছেন, তাঁদের প্রশংসা করুন।
অলস ভাবনা নয়: ‘আমার কী হবে’, ‘আর বোধ হয় কোনো আশা নেই’ এমন হতাশ ভাবনায় আবিষ্ট না থেকে আপনার পক্ষে এ বিপদ মোকাবিলায় যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকু করার চেষ্টা করুন। অন্তত করোনা রোগীর সেবায় যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বা বন্যা মোকাবিলায় যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে আছেন, তাঁদের উদ্দেশে দুই কলম ধন্যবাদ বার্তা লিখুন, হোক তা ফেসবুকে। এতে আপনার নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
নিজের যত্ন নিন
হতবিহ্বল না হয়ে নিজের শরীর আর মনের যত্ন নিন। করোনাবিষয়ক সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। বন্যা–উপদ্রুত এলাকায় নিরাপদে থাকতে চেষ্টা করুন। মনের যত্ন নিতে নিজেকে সময় দিন। প্রতিদিন কিছু পড়ুন, লিখুন। পরিবারের সদস্যদের গুণগত সময় দিন, পরস্পরের আবেগগুলোকে ভাগ করে নিন। স্বজন বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে সংযুক্ত থাকুন, সবার খোঁজখবর নিন। মনের যত্ন নিতে ইউটিউব দেখে মাইন্ডফুলনেস, ইয়োগা, বডিস্ক্যান বা রিলাক্সেশনের চর্চা করতে পারেন। রাতে পরিমিত ঘুমাবেন, দিনে সক্রিয় থাকবেন—রাত জাগবেন না, দিনে বেশি সময় ঘুমাবেন না।
সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করুন
এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক আর কর্মজীবনের জন্য একটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করুন। সব আগের মতো করতে পারবেন না, এটি মাথায় রেখে বিকল্প উপায়গুলো খুঁজে দেখুন। বিকল্প উপায়ে চলতে গিয়ে সব সময় আফসোস করবেন না, মনে রাখবেন এ বিকল্প উপায়গুলো বেছে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজেকে নিরাপদ আর সক্রিয় রাখা। তাই বিকল্প জীবনাচারকেও উপভোগ করার চেষ্টা করুন।
সহযোগিতা
পরিবর্তিত পরিস্থিতি সবার জন্যই নতুন। তাই যেকোনো কিছুতে হোঁচট খেতেই পারেন। থেমে যাবেন না। প্রয়োজনে অপরের সাহায্য প্রার্থনা করুন। সাধ্যানুযায়ী অপরকে সহযোগিতা করুন। নিজের ভেতর পরার্থপরতার চর্চা করুন। দিন শেষে এ পরার্থপরতা আপনার মনকে অনেকখানি চাঙা করে দেবে।
নিজেকে ধন্যবাদ দিন
প্রতিদিন একবার করে আপনি নিজেকে ধন্যবাদ দিন। নিজের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন। কোনো মহৎ কাজ করেছেন বলে নয়—মনে করুন, এ প্রতিকূলতার মধ্যেও আপনার ওপর অর্পিত ছোট-বড় কাজগুলো সাধ্যানুযায়ী করে নিজেকে নিরাপদে রাখতে পেরেছেন বলেই নিজেকে ধন্যবাদ দিন।
মনোযোগ দিন যা আপনার নিয়ন্ত্রণে
আশপাশের ঘটনাপ্রবাহের সবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই সবকিছু নিয়ে চিন্তা করে নিজের মেধা আর শক্তি ক্ষয় করবেন না। যেমন বন্যার পানি বেড়ে যাওয়া বা নেমে যাওয়া নিয়ে মনোযোগী না হয়ে কীভাবে বন্যায় নিজেকে নিরাপদে রাখতে পারবেন, সেদিকে মনোযোগী হোন, যা আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন কেবল সেদিকেই মনোযোগী হোন।
নিজের আবেগের সঙ্গে মানিয়ে নিন
মনের মধ্যে এ সময় নানা ইতিবাচক, নেতিবাচক আবেগের ঝড় বইতে পারে। যুক্তি আর পারিপার্শ্বিকতাকে বিবেচনা করে আবেগগুলোকে যথাযথভাবে প্রকাশ করুন, অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিন আর অপরের আবেগগুলো বোঝার চেষ্টা করুন।
ভালো দিকগুলো খুঁজে দেখুন
খারাপ ঘটনার কোনো সরাসরি ভালো দিক পাওয়া মুশকিল। কিন্তু প্রতিটি দুর্যোগ আর বিপদ আমাদের খানিকটা অভিজ্ঞ করে তোলে। ব্যক্তিগত আর সামষ্টিক উন্নতিতে এ অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করুন। সংকটকে সম্ভাবনা হিসেবে ভাবতে শিখুন।
প্রতিটি দিনকে উপভোগ করুন
প্রতিটি দিনকে একটি নতুন দিন হিসেবে গুনতে শিখুন। একেকটি দিন আপনার জন্য যেন উপভোগ্য হয়ে ওঠে সেভাবে কিছু না কিছু কাজ করার চেষ্টা করুন। যাতে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় নিজেকে নিজের অর্জনটুকু বলতে পারেন।
অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করুন
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চাহিদা আর প্রাপ্তির মধ্যে একটা বড় দূরত্ব থাকতে পারে। আপনার চাহিদাগুলোর একটি ক্রম ঠিক করুন। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঠিক করুন কোনটি অতি প্রয়োজনীয় আর কোনটি না হলেও চলে। এ তালিকা অনুযায়ী প্রাপ্তি হিসাব করুন, তাতে আপনার হতাশ হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যাবে।
বিচারকের ভূমিকায় নয়
চারপাশের মানুষ আর ঘটনার প্রতি জাজমেন্টাল হবেন না। প্রতিটি ঘটনা আর আচরণ নিজ নিজ পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে গ্রহণ করুন। সবকিছু নিজের দিক থেকে দেখবেন না। কোনো ঘটনায় কারও প্রতি আপনি বিরূপ হলে, তার অবস্থান আর তার দৃষ্টি দিয়ে বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করুন।
অপরের মতামতের প্রতি মূল্য দিন
পরিবারে এবং চারপাশে যারা আছে তাদের মতামতকে মূল্য দিতে চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন এই বর্তমান প্রতিকূলতায় সবাই মানসিক চাপে আছে। তাই তাদের ভাবনাগুলো যে তাদের নিজস্ব সেটা ভাবুন। নিজের ভাবনাটিকে যুক্তি দিয়ে প্রকাশ করুন, তবে অপরের ভাবনাকে প্রতিহত করতে গিয়ে তার মনে আরও চাপ বাড়াবেন না।
মনে রাখবেন, পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন আপনি যদি মনকে ভালো রাখতে না পারেন, নিজের মনোবল দৃঢ় রাখতে না পারেন তবে আপনি হতাশ হয়ে যাবেন। তাতে প্রতিকূল পরিস্থিতি আপনাকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই পরিস্থিতিকে যদি সামান্যতমও বদলে ভালো থাকতে চান, তবে আপনাকে চাঙা থাকতেই হবে।
Leave a Reply