প্রাথমিক শিক্ষায় বাতিল হওয়া জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষাক্রম (পরিমার্জিত ২০২১) বিস্তরণ কারিকুলাম বিষয়ে প্রশিক্ষণ আয়োজন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপজেলা রিসোর্স সেন্টার। সারা দেশে ৩০১টি ব্যাচের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ টাকা।
অভিযোগ উঠেছে অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ বিভাগকে ম্যানেজ করে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইন্সট্রাক্টরগণ মাঠ পর্যায়ে এ প্রশিক্ষণের বরাদ্দ এনেছেন। প্রতি আর্থিক বছরের শেষ দিকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে ইন্সট্রাক্টরদের সুবিধা দিতে এমন আয়োজন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
যে কারিকুলামের ওপর মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হচ্ছে তা বাতিল করে নতুন কারিকলামে প্রথম প্রান্তিক মূল্যায়ন পরীক্ষা চলমান রয়েছে। বাতিল হওয়া কারিকলাম প্রশিক্ষণ কোন কাজে আসবে না জেনেও অধিদপ্তর কেন প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে তা নিয়ে মাঠ পর্যায়সহ শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে আর্থিক বছরের শেষ দিকে বিধায় সরকারের কোটি কোটি টাকা হরিলুট করার জন্যই এসব প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ডিভিশনের নবনিয়োগকৃত সহকারী শিক্ষকদের ৩ দিনের কারিকুলাম প্রশিক্ষণ ইতিমধ্যে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের অনুকুলে এ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা। প্রশিক্ষণ পরিচালনায় ইন্সট্রাক্টরা তোড়জোড় শুরু করেছে। ৫ আগষ্ট গণ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সাথে সাথে কারিকুলাম স্থগিত করা হয়েছে। জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুন মূল্যায়ন নির্দেশিকা প্রণয়ন করে মাঠ পর্যায়ে প্রেরণ করেছে। নতুন মূল্যায়ন নির্দেশিকার আলোকে গত ৫মে থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম প্রান্তিক মূল্যায়ন শুরু হয়েছে।
এদিকে গত বছরের ২ জুলাই অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি এন্ড অপারেশন) মো. লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে ১ম শ্রেণি থেকে ৩য় শ্রেণির ধারাবহিক মূলায়ন (ডায়েরী-১ ও ডায়েরী-২) স্থগিত করা হয়েছে। বিগত সরকারের প্রণয়নকৃত জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ বিস্তরণ বিষয়ক কারিকুলামের ওপর অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। আগামী ৩০ জুন ২০২৪-২৫ আর্থিক বছর শেষ হবে। লুটপাটের জন্য বাতিল কারিকুলাম বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে বলে অভিভাবকেরা মনে করছেন। এদিকে প্রশিক্ষণের ইতিহাসে এই প্রথম প্রশিক্ষণার্থী প্রতি ৫০০ টাকা উপকরণ ও প্রশাসনিক খরচ বাবদ ব্যাচ প্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিষয়ভিত্তিকসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণে উপকরণ বাবদ জন প্রতি ৬০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইউআরসি আয়োজিত বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণে নাম মাত্র ৩৫/৪০ টাকার উপকরণ দেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে কারিকুলাম প্রশিক্ষণে উপকরণ ও প্রশাসনিক বরাদ্দ থেকে অতিরিক্ত অর্থ অধিদপ্তরের কর্তারা পাবেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ইন্সট্রাক্টর জানিয়েছেন। এদিকে এই প্রশিক্ষণ বিষয়ক কথোপকথনের একটি স্কিনশর্ট দেশ রুপান্তরের হাতে এসেছে। সেখানে লেখা রয়েছে ‘হায়রে কপাল!!! উপকরণে ৫০০ টাকা হারে পোস্টারবপেপার, সাইনপেন, কলম, ইরেজার। আবার প্রশাসনিক ব্যয়েও সেইম ২৫০০ টাকা। আমি প্রশিক্ষক হিসাবে দেখলাম ৫০০ টাকার উপকরণে ৪০ টাকা ব্যয় আর ২৫০০ টাকাতো কোল্ডস্টোরে আছে।’ প্রতিউত্তরে আরেকজন বলেন ‘এখান থেকে অনেকেই ভাগ পায়। অথর্ব ইউআরসি ইন্সট্রাক্টরের একার পক্ষে এত টাকা আত্নসাত করা অসম্ভব।’
দেশ সেরা প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আগামি রবিবার থেকে কারিকুলাম বিস্তরণের উপর প্রশিক্ষণ রয়েছে। যদি এটা পুরাতন কারিকুলারে আলোকে হয় তাহলে শ্রেণিপাঠদান বা পেশাগত দক্ষতায় এর কোন সুফল আসবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রশিক্ষণ সম্পর্কে অনেকেই অবগত। এটা জেনে শুনে অর্থ লোপাটের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। শুধুমাত্র কিছু লোকের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার নামে এই প্রশিক্ষণটি স্থগিত করা উচিত।
বাতিল কারিকুলামে প্রশিক্ষণে প্রজ্ঞাপণ জারী করা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. ইমামুল ইসলাম বলেন, এখন অফিস শেষ হয়ে গেছে। আমি অফিসের বাইরে। এই বিষয়ে বলতে গেলে কিছু কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমি আগামী রবিবার আপনাকে বিস্তারিত কথা বলবো।
প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মীর্জা আজিজুল ইসলাম দেশ রুপান্তরকে বলেন, যে খাতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় যদি সেই খাতে অর্থ ব্যয় না হয় তাহলে বরাদ্দকৃত অর্থ সরকারের ফান্ডে চলে যাবে। পরে সেটি অন্য কোন খাতে ব্যয় হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দেশ রুপান্তরকে বলেন, যে কারিকুলাম বাতিল হয়ে গেছে সে কারিকুলামের জন্য প্রশিক্ষণ কোনভাবেই কাম্য নয়। এর সাথে যারা জড়িত রয়েছে তাদের স্বার্থরক্ষার আয়োজন মাত্র। এই প্রশিক্ষণ আয়োজনে পেশাগত কোন লাভ হবে না বরং তাদের ব্যক্তি সুবিধা হাসিল হবে। জনগণের অর্থ এভাবে ব্যয় করা কোন ভাবেই কাম্য নয়। বাতিল কারিকুলামে ব্যয় না করে অন্য কোন ভাবে পেশাগত দক্ষতা অর্জনে এটা ব্যয় কর যেতে পারে। জনগণের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে এরূপ অপচয় করা অগ্রহণযোগ্য। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্তের মাধ্যমে প্রকল্পের অনুমোদন, অর্থছাড় ও বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ঠ সকলের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, এই বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
Leave a Reply