রাসেল’স ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে দেখামাত্রই সাপ মারছেন আতঙ্কিত মানুষ। রাসেল’স ভাইপার মনে করে সারাদেশে পিটিয়ে মারা হচ্ছে অজগর, দাঁড়াশ, ঘরগিন্নির মতো নির্বিষ কিংবা মৃদু বিষধর অনেক সাপ। না বুঝেই মারা হচ্ছে বিপন্ন প্রজাতির সাপও। বন বিভাগের হটলাইনে রাসেল’স ভাইপার সম্পর্কিত যেসব ফোনকল আসছে, বন বিভাগ বলছে সেগুলোর ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই নির্বিষ সাপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বিচারে সাপ মারার মারাত্মক প্রভাব পড়বে কৃষি ও পরিবেশের ওপর; ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য আর ব্যাহত হবে ফসল উৎপাদন। এদিকে ভুল তথ্য ও সংঘবদ্ধ আক্রমণের কারণে রাসেল’স ভাইপারের বিলুপ্তির শঙ্কা প্রকাশ করেছে জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
বন বিভাগ জানায়, রাসেল’স ভাইপারের মতো দেখতে বেশ কিছু প্রজাতির সাপ দেশে থাকায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার আতঙ্কিত মানুষ তাদের হটলাইনে ফোন করছে। জীবিত ও মৃত সাপের ছবি পাঠাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে তাদের হটলাইনের পাঁচটি নম্বরের প্রতিটিতে ঘণ্টায় ১৫০টিরও বেশি ফোনকল আসছে।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ^াস আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই ফোন করে তাদের বাড়িতে সাপের উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন। তথ্যদাতাকে ছবি পাঠাতে বললে কেউ সাপ মেরে, কেউ জীবিত সাপের ছবি দিচ্ছেন। তবে সেগুলোর ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই দাঁড়াশ, অজগর, বেত আচড়া, ঘরগিন্নি, মেটে সাপের মতো নির্বিষ ও মৃদু বিষধর সাপ। গুজবে মানুষ নিরীহ এবং প্রকৃতির জন্য উপকারী সাপ মেরে ফেলছে। আমরা কলদাতাকে সাপ না মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’
ছড়িয়ে পড়ছে বিভ্রান্তিকর তথ্য বন বিভাগের তথ্যমতে, ২৭টি জেলায় রাসেল’স ভাইপারের দেখা মিলেছে। সম্প্রতি নতুন করে রাসেল’স ভাইপার ছড়িয়ে পড়ার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এলে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। বাড়তে থাকে গুজব। সাপ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, জুন-জুলাই মাস সাপের প্রজনন মৌসুম। প্রতিবছরই এ সময়ে সাপের উপদ্রব বাড়ে।
তাই রাসেল’স ভাইপারের বিস্তারের যে তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে তা সঠিক নয়।
স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশের সভাপতি রাজু আহমেদ বলেন, রাসেল’স ভাইপার ২৭ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছেÑ এর অর্থ তো এটা না যে জেলার সবখানে রাসেল’স ভাইপার আছে। হতে পারে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় দেখা গেছে। গত চার মাসে শরীয়তপুর, কুষ্টিয়া ও ভোলা থেকে মাত্র পাঁচটি রাসেল’স ভাইপার সাপ আমরা উদ্ধার করেছি।’
সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ভেনম রিসার্চ সেন্টার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গুজবের ক্ষেত্রে পুরনো ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে রাসেল’স ভাইপার থাকার সম্ভাবনা নেই, সে জায়গারও ছবিতে সাপটি দেখানো হচ্ছে। এমন সব প্রজাতির সাপের ছবি প্রচার করা হচ্ছে, যার অস্তিত্বই নেই বাংলাদেশে।
রাসেল’স ভাইপার গবেষক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘রাসেল’স ভাইপার বহু বছর ধরেই আমাদের প্রকৃতিতে ছিল। এই সাপ তেড়ে এসে কাউকে কামড়ায় না। এরা লোকালয়েও আসে না। বনের প্রান্তে কিংবা ফসলের ক্ষেতের আশপাশে থাকে।’ কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে অ্যান্টিভেনম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
রাসেল’স ভাইপার বিলুপ্তির শঙ্কা
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেল’স ভাইপার সাপটি বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রজাতির। নির্বিচারে সাপ মারা হলে রাসেল’স ভাইপার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা সংগঠন ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের।
সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা ম্যাপিং করে দেখেছি রাসেল’স ভাইপারের আবাসস্থলগুলোতেই এরা আছে। সাপ ছড়িয়ে পড়ার যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, সেটি আসলে পুরোপুরি সঠিক নয়। বিশেষ করে প্রজনন মৌসুমে রাসেল’স ভাইপারের ওপর যেভাবে আক্রমণ বেড়েছে, তাতে এই সাপ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।’
নেতিবাচক প্রভাব জীববৈচিত্র্য ও কৃষিতে
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রায় ৯৪ প্রজাতির সাপ আছে, যাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই নির্বিষ। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এসব সাপের ভূমিকা ব্যাপক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপ মেরে ফেললে এর প্রভাব পড়বে পুরো বাস্তুচক্রে। ফসলি ক্ষেতে সাপ মারলে ইঁদুরসহ ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের প্রভাব বাড়বে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছরই মোট উৎপাদিত ফসলের ১০ থেকে ২০ শতাংশ ফসল ইঁদুর নষ্ট করে। আর পোকামাকড়ের কারণে বার্ষিক ফলনের ক্ষতি হচ্ছে ধানের ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ, গম ১১ শতাংশ, আখ ২০ শতাংশ, সবজিতে ২৫ শতাংশ, পাট ১৫ শতাংশ এবং ডাল ফসলে ২৫ শতাংশ।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফিরোজ জামান আমাদের সময়কে বলেন, সাপের সংখ্যা যত কমে যাবে ইঁদুরের সংখ্যা, কীটপতঙ্গের সংখ্যা তত বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে কৃষিতে। উৎপাদিত ফসলের অর্ধেকই নষ্ট করে ফেলবে এসব কীটপতঙ্গ। ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক এবং খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা। বন বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সাপ মারা বন্ধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে।
Leave a Reply