পাঁচ মাস বয়সী আবদুল আজিজ আল-হোরানি, উত্তর গাজার আল-আহলি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে, তার ছোট্ট শরীরে অপুষ্টির লক্ষণ স্পষ্ট।
মাত্র তিন কেজি (৬.৬ পাউন্ড) ওজনের, আবদুল আজিজ সম্প্রতি নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) থেকে ছাড়া পেয়েছে। সেখানে তাকে গুরুতর অপুষ্টির জন্য চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
তার মা বলছেন তিনি গাজায় তার প্রয়োজনীয় খাবার পাচ্ছেন না।
‘ও আমার একমাত্র সন্তান। ওজন কমপক্ষে পাঁচ কেজি (১১ পাউন্ড) হওয়া উচিত এবং আমি ওর স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমি ওকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারছি না, কারণ সীমান্ত বন্ধ,’ বলেন তিনি।
আবদুল আজিজের গল্পটি অবশ্য ভিন্ন কিছু নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী আট হাজারেরও বেশি শিশুর তীব্র অপুষ্টি শনাক্ত হয় এবং চিকিৎসা করা হয়- এর মধ্যে ১৬০০ ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
গত সপ্তাহে, ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেইয়েসাস বলেছেন, ‘ইতোমধ্যেই অপুষ্টির কারণে ৩২টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২৮টিই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।’
জুনের শুরুতে জাতিসঙ্ঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানায়ে, গাজার প্রতি ১০টির মধ্যে নয়টি শিশু তীব্র খাদ্য অভাবের সম্মুখীন, প্রতিদিন দুই বা তারও কম রকমের খাবার খেয়ে বেঁচে আছে তারা।
এতে বলা হয়, ‘মাসব্যাপী অভিযান এবং মানবিক সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞায় খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, যার ফলে বিপর্যয়কর পরিণতি দেখা দিয়েছে’ এবং শিশুদের ‘জীবন-হুমকিপূর্ণ অপুষ্টির ঝুঁকিতে’ রয়েছে।
শূন্য বাজার
আমার জন্ম গাজায়, আমি আমার পরিবারের সাথে এখানে বসবাস করেছি – ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও আমি গাজা থেকেই প্রতিবেদন করেছি।
যুদ্ধের আগে, আমি উত্তর গাজার আল-তুফাহ জেলাকে হাজারো ক্রেতার ভিড়ে জমজমাট একটি স্থান হিসেবে জানতাম। কিন্তু এখন যখন আমি সেখানে থাকা লোকদের ফোন করে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই, তারা আমাকে যে ছবি পাঠায়, তাতে দেখা যায় এটি এখন প্রায় জনশূন্য।
‘টমেটো নেই, শসা নেই, ফল নেই, এবং রুটিও নেই,’ বাজারের এক বয়স্ক ব্যক্তি সালিম শাবাকা এমনটা বলেন।
তিনি জানান যে কেবল কিছু ব্যবহৃত পোশাক এবং সীমিত পরিমাণে টিনজাত খাবার বিক্রির জন্য রয়েছে।
‘আমরা এমন জীবন কখনো জানতাম না, কেনার বা বিক্রির জন্য কিছু নেই,’ আরেকজন বিক্রেতা যোগ করেন।
‘আমার সাতটি সন্তান আছে এবং আমি কোনো ত্রাণ সাহায্য পাইনি।’
প্রতিদিন, ‘টিকেয়াস’ – ছোট খাবারের স্টল যেখানে বিনামূল্যে খাবার প্রদান করা হয়, তাদের সামনে দীর্ঘ সারি দেখা যায়। অনেকেই উত্তর গাজায় কিছুটা সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে থাকে, কিন্তু সরবরাহের ঘাটতি তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে।
এখন এটি এমন একটি স্থান, যেখানে কিছু শিশু একটু গরম খাবারের আশায় ভিড় করে, আর অন্যরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হেঁটে পানি আনতে যায়।
ক্ষুধা ও রোগ
প্রায় প্রতিদিনই আমি গাজায় থাকা আত্মীয় এবং বন্ধুদের সাথে কথা বলি। তাদের পাঠানো ছবিতে আমি দেখতে পাই তারা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের মুখের পরিবর্তনও চোখে পড়ে।
আর ডব্লিউএইচও-র প্রধান ড. টেড্রোস সতর্ক করে বলেন যে, ‘খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধির রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও, বর্তমানে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারা পর্যাপ্ত পরিমাণ এবং গুণগত মানের খাবার পাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, নিরাপত্তাহীনতা এবং নানান নিষেধাজ্ঞার ফলে, বর্তমানে গুরুতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য মাত্র দু’টি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু রয়েছে। তিনি সতর্ক করেছেন যে স্বাস্থ্য সেবা, বিশুদ্ধ পানি এবং স্যানিটেশনের অভাব ‘অপুষ্ট শিশুদের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়।’
এই পরিস্থিতির কারণে সংক্রামক বিভিন্ন রোগ, যেমন- হেপাটাইটিস, ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বেশি। বেশিরভাগ হাসপাতাল এবং ক্লিনিক বন্ধ রয়েছে এবং যেগুলো এখনো চালু রয়েছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এবং জনাকীর্ণ।
‘আমরা একেবারে ক্লান্ত এবং শক্তিহীন,’ বলেন উত্তর গাজার জাবালিয়ার বৃদ্ধা উম ফুয়াদ জাবের। ‘আমরা কয়েকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছি এবং প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে।’
‘আমরা পশু-পাখিদের খাবার খেয়েছি এবং অপুষ্টির কারণে শিশু ও নারীরা অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। রোগ আমাদের শরীরকে খেয়ে ফেলেছে।’
ফিলিস্তিনি ডাক্তার মোতাসেম সাঈদ সালাহ, হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরুরি কমিটির একজন সদস্য, নিশ্চিত করেছেন যে প্রতিদিন অপুষ্টির অনেকগুলো ঘটনা রিপোর্ট করা হচ্ছে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের মধ্যে।
তিনি বলেন, অনেক মানুষ, যারা ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছে, তারা এখন অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সাথেও সংগ্রাম করছে।
মানবিক সহায়তার চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধ শুরু হয়েছিল গত বছরের ৭ অক্টোবর, যখন হামাস ইসরাইলে আক্রমণ করে প্রায় ১২০০ মানুষকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসে।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৩৭,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং আরো হাজার হাজার মানুষ আহত বা বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
গাজার মানুষ টিকে থাকার জন্য মানবিক সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরবরাহ সেখানে পৌঁছাতে পারছে না।
একসময় গাজার দক্ষিণে মিসরের সীমান্তে রাফাহ ক্রসিং ছিল সহায়তার প্রধান প্রবেশপথ। কিন্তু এখন ইসরাইল গাজার পাশের ক্রসিংটি নিয়ন্ত্রণ করছে, ফলে এটি বন্ধ হয়ে গেছে।
দক্ষিণে আরো রয়েছে ইসরাইল থেকে খোলা কেরেম শালোম গেটওয়ে, তবে যুদ্ধের কারণে এই রুটে সহায়তার প্রবাহ সীমিত হয়েছে।
কিছু খাদ্য সহায়তা উত্তরে নতুন ক্রসিং পয়েন্টের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে, তবে জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান অনুসারে ৭ মে থেকে সহায়তার পরিমাণ দুই-তৃতীয়াংশ কমে গিয়েছে এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে দক্ষিণেও সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে।
খারাপ আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে একটি মার্কিন ভাসমান জেটি কয়েকদিন ধরে বন্ধ অবস্থায় ছিল এবং পরে আন্তর্জাতিক সীমানায় সাময়িকভাবে সরানো হয়েছে।
বিশ্বের ২০টি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে যে ‘গাজার মধ্যে অনিয়মিত সহায়তা, এক ধরনের মরীচিকা তৈরি করেছে, যখন মানবিক সাহায্য প্রক্রিয়া প্রায় ভেঙে পড়ার পথে।’
গত সপ্তাহে, গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত সরকার জানায় যে প্রতিদিন গাজায় ৩৫টির বেশি ট্রাক পৌঁছাচ্ছে না এবং এগুলোই শুধুমাত্র উত্তর গাজার সাত লাখ মানুষের জন্য খাবার এবং ওষুধের একমাত্র উৎস।
কিন্তু ১৩ জুন, ইসরাইলের মানবিক সমন্বয় কর্তৃপক্ষ কোগাট সামাজিক মাধ্যম এক্সে একটি পোস্টে বলে, ‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় এক বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। গাজায় প্রবেশের জন্য মানবিক সহায়তার কোনো পরিসীমা নেই, সমস্ত ধরনের ওষুধও এখানে প্রবেশ করতে পারে।’
একইদিনে আরেকটি পোস্টে বলা হয় যে ওই দিন ২২০টি সহায়তার ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। এটি খাদ্য এবং অন্যান্য সরবরাহ বিতরণে সাহায্য সংস্থাগুলির ব্যর্থতাকে দায়ী করে বলেছে যে প্রায় ১৪০০ সহায়তা ট্রাক এখনো প্রবেশ করার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ বলেছে, যেসব ত্রাণ প্রবেশ করছে, সেটা বিলি করতে গিয়ে কাড়াকাড়ি, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া এবং অন্যান্য ইসরাইলি নিষেধাজ্ঞার কারণে মারাত্মকভাবে এই সহায়তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রোববার ইসরাইলি সেনাবাহিনী দক্ষিণ গাজার একটি সড়ক বরাবর আরো মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিতে প্রতিদিন একটা ‘সামরিক কার্যকলাপের কৌশলগত বিরতি’ ঘোষণা করেছে।
তবে তারা জোর দিয়ে বলেছে যে কোনো যুদ্ধবিরতি নেই এবং রাফাহতে যুদ্ধ চলবে। ইসরাইল বলেছে যে রাফাহ তাদের অভিযানের প্রয়োজন হামাসকে তাদের ‘শেষ প্রধান ঘাঁটি’ থেকে উৎখাত করার জন্য।
জাতিসঙ্ঘের একজন মুখপাত্র এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এতে এখনো সহায়তার পরিমাণ বাড়েনি।
জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলো এর আগেও সতর্ক করেছিল যে সহিংসতা অব্যাহত থাকলে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে গাজায় এক মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনি তীব্র খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হতে পারে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply