ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সোর্স গাড়িচালক জালাল আহমেদ ওরফে শফিক হত্যা মামলা অবশেষে ২৪ বছর পর রায়ের দিকে যাচ্ছে। মামলাটিতে ইতোমধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করে আদালত আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির জন্য দিন ঠিক করেছেন।
ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আগামী ৩০ মার্চ এ মামলায় আত্মপক্ষ শুনানি হবে। শুনানির পর যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা করবেন আদালত।
মামলাটির বিচার নিয়ে বর্তমান আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা যে সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করেছি তাতে আমরা মনে করি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। তাই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তিই আমরা প্রত্যাশা করছি।
তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, মামলায় নিহত জালালের দুই সন্তান পপি ও আব্বাসের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। আর উদ্ধার হওয়া লাশ যে জালালের তাই তো প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। তাই আমরা মনে করি আসামিরা খালাস পাবে।
৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে এ মামলায় ২০০১ সালের ১২ মার্চ শুরুর পর মাত্র দেড় বছরের মধ্যে মামলাটির ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ করেছিল আদালত। যার পরবর্তী দুই বছরের ২ জন (যার মধ্যে একজন আংশিক সাক্ষ্য দিয়েছেন) এবং মাঝে ১০ বছর সাক্ষ্যগ্রহণহীন থাকার পরের দুই বছরে ৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। এর পরের ৬ বছরে একজন সাক্ষীও আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে ঝুলে ছিল আলোচিত এ মামলার বিচার।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত এখন নিহত জালালের দুই সন্তান এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির তৎকালীন এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানসহ ৪ জনের সাক্ষ্যের জন্যই ঝুলে ছিল এ মামলার বিচার।
নথি থেকে আরও দেখা যায়, মামলার আসামির মধ্যে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. জিয়াউল হাসান, হাবিলদার মো. বিল্লাল হোসেন ও কনস্টেবল মো. আব্দুর রউফ জামিনে আছেন। ড্রাইভার পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল মালেক জামিনে পলাতক। অপর আসামি পুলিশ কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন ২০০১ সালে মারা গেছেন।
১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ মিন্টো রোড ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ের ছাদের পানির ট্যাংক থেকে জালালের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় লাশ শনাক্ত হওয়ার আগেই রমনা থানার তৎকালীন এসআই এসএম আলী আজম সিদ্দিকী অজ্ঞাত লাশ ও অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের ২৬ মার্চ একটি মামলা করেন। পরে লাশ শনাক্ত হওয়ার পর ওই বছর ৪ এপ্রিল নিহতের ছেলে আব্বাসউদ্দিন একটি মামলা করেন।
আব্বাসউদ্দিনের মামলার এজাহার অনুযায়ী নিহত জালাল ছিলেন মাইক্রোবাস চালক। প্রথমে নিজের মাইক্রোবাস চালাতেন। পরে নিজ মাইক্রোবাস বিক্রি করে ভাড়ায় চালাতেন। ডিবি পুলিশ কোনো গাড়ি রিকুইজিশন (চাওয়া) করলে সে গাড়ি চালানোর জন্য তাকে ডাকা হতো। ওই কারণে ডিবি অফিসের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আসামি জিয়াউল হাসান ও এসআই আরজু প্রায়ই তাকে ডেকে নিতেন। ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়ার বাসা থেকে গাড়ির লাইসেন্স ও চেক বই নিয়ে রাত ৩টায় ডিবি অফিসের উদ্দেশে বের হন জালাল। তারপর কয়েক দিন বাড়িতে না ফেরায় পরিবারে ধারণা ছিল তিনি ঢাকার বাইরে গেছেন। ওই বছর ৩১ মার্চ কয়েকজন লোক বাসায় এসে জালালের ছবি দেখিয়ে পরিচয় জানতে চায়। এরপর পরিবারের লোকজন ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।
মামলার চার্জশিটে হত্যার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় অবৈধ স্বর্ণ, হেরোইন ও মাদক চোরাচালানের খবর আসামি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক জিয়াউল হাসানকে দিতেন। কিন্তু জালাল ওই কাজের জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ায় তিনি গোয়েন্দাদের অন্য টিমকে ওই সংবাদ দিতে শুরু করেন। মূলত এ কারণে ১৯৯৯ সালের ১৯ মার্চ রাতে তাকে বাসা থেকে ডেকে এনে হত্যা করে ডিবি পুলিশ কার্যালয়ের ছাদের পানির ট্যাংকের ভেতর তার লাশ লুকিয়ে রাখা হয়।
হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৫ মাসের মধ্যে ১৯৯৯ সালের ৯ আগস্ট মামলাটিতে সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মুন্সি আতিকুর রহমান আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
ওই বছরেই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক মুনিরা মাহফুজা। ৪৫ সাক্ষীর এ মামলায় ২০০১ সালের ১২ মার্চ শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
নথিতে দেখা যায়, ২০০২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০টির অধিক ধার্য তারিখে ১৯ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। যাদের মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন নিহতের মা হালিমা বেগম এবং ছেলে ফারুক হোসেন। পরের বছর ২০০৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইমাম আলী নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক আদালতে আংশিক সাক্ষ্য দিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরে যান। এরপর তিনি আর সাক্ষ্য দিতে আসেননি। এরপর মাঝে ১১ বছর গেছে সাক্ষ্যগ্রহণহীন। ২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মোক্তার আলী, ১৩ মার্চ জাকির উল ইসলাম, খন্দকার মো. শফিকুল আলম ও খন্দকার মো. শাহ আলম নামের সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর পরের বছর ২৫ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মুন্সি আতিকুর রহমান মামলায় আংশিক জবানবন্দি দিয়ে আর আদালতে আসেননি। সম্প্রতি তিনি বাকি সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মামলার নথি দৃষ্টে দেখা যায়, মামলাটিতে প্রথম চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। এ আদালত থেকে ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বদলি করা হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৩০ জুন দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বদলি করা হয়। মামলার বিচারকালে এ পর্যন্ত অসংখ্য বিচারক এবং সরকারি কৌঁসুলি বদল হয়েছে।
উল্লেখ্য, এ মামলা পরিচালনায় গাফিলতির অভিযোগও ওঠে মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন রাষ্ট্রপক্ষের ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে (সাবেক খাদ্যমন্ত্রী)। অভিযোগের সত্যতা থাকায় তাকে মামলার কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট। ২০০১ সালের ২৮ জানুয়ারি বিচারপতি আলী আসগর খান ও বিচারপতি এসকে সিনহার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ এক স্বতঃপ্রণোদিত আদেশে পিপি পরিবর্তন এবং মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন।
Leave a Reply