পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশভূমিতে ফিরে আসার ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের বড় আশীর্বাদ। যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির নেতাকে হত্যা করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল, তাদেরই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের পেছনে একদিকে ছিল প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ, অন্যদিকে বাংলাদেশের মাটিতে পরাজিত এবং আত্মসমর্পণকৃত পাকিস্তানি সেনাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার তাগিদ।
বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের ভূমিকা ছিল অসামান্য, যা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা যেন বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত বিচার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তিনি যেন সসম্মানে স্বদেশ ফিরতে পারেন সে লক্ষ্যে বিশ্বের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারপ্রধানের দুয়ারে বারবার ধরনা দিয়েছেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। শেখ মুজিবের মুক্তিকে সংকট সমাধানের অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে গোটা বিশ্বে প্রবল প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। এর পরও বঙ্গবন্ধুকে যখন প্রহসনমূলক গোপন বিচারে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত করা হয়, তখন ২৪ জন শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে জরুরি ব্যক্তিগত আবেদন পাঠান ভারত নেত্রী। ঠিক একই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড দিয়ে পরিস্থিতি যেন আরো জটিল করে না তোলা হয়, সে বার্তা দিয়ে পাকিস্তানকে শক্ত ভাষায় সতর্ক করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। গোটা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে ভূমিকা রাখে।
১১ আগস্ট ১৯৭১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের প্রধান প্রধান সরকারপ্রধানের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ যে বার্তাটি প্রেরণ করেন তা ছিল এ রকম : ‘Government and people of India as well as our Press and Parliament are greatly perturbed by the reported statement of President Yahya khan that he is going to start secret military trial of Mujibur Rahman without affording him any foreign legal assistance. We apprehend that this so-called trial will be used only as a cover to execute Sheikh Mujibur Rahman. This will aggravate the situation in East Bengal and will create a serious situation in India because of the strong feelings of our people and all political parties.’
৪ নভেম্বর ১৯৭১ হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন শ্রীমতি গান্ধী, বৈঠকের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। কিন্তু সে বৈঠক ব্যর্থ হয়। এর পরও বাংলাদেশ প্রশ্নে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানপন্থী কৌশল অকার্যকর করতে সক্ষম হন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর যুক্তি, দৃঢ়তা ও বিস্ময়কর কূটনীতির ফলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে আসে।
এদিকে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে অক্টোবর-নভেম্বর থেকে পাকিস্তান বাহিনী ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হতে থাকে। ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিম অংশে পাকিস্তান আকস্মিক আক্রমণ চালালে যুদ্ধ পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড’। সেদিন থেকেই হানাদার বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালাতে থাকে যৌথ বাহিনী। একই দিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালিতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক বসে। সে বৈঠকে ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর করার প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুইবার ‘ভেটো’ প্রদান করে প্রস্তাবকে অকার্যকর করে দেয়। সোভিয়েত ‘ভেটো’ পাকিস্তানের পরাজয় এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পরাজিত পাকিস্তান বাহিনী মুক্ত ঢাকায় লাখো মানুষের আকাশ ফাটা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং জয় ইন্দিরা গান্ধী ধ্বনির মধ্যে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ পরিপূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হয় সেদিন। ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাদের সরকারের কাছে দুটি সুপারিশ পাঠায়। প্রথমটি দ্রুত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং দ্বিতীয়টি অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত।
ইন্দিরা গান্ধী বিলক্ষণ অনুধাবন করেন, পাকিস্তান শুধু পরাজিতই নয়, দেশটির প্রায় এক লাখ সেনা বাংলাদেশ ও ভারতের মাটিতে বন্দি, কাজেই বাঙালির নেতাকে মুক্ত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই তাদের সামনে। কাজেই ১৬ই ডিসেম্বর লোকসভায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক খবরটি যখন তিনি দেশবাসীকে জানান তখন তিনি বলেন :
We hope and trust that the Father of this new nation, Sheikh Mujibur Rahman, will take his rightful place among his own people and lead Bangladesh to peace, progress and prosperity .
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসে বুধবার, ডিসেম্বর ২২, ১৯৭১। শত্রুমুক্ত ঢাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা এসে পৌঁছলে হাজার হাজার মানুষ তাঁদের বীরোচিত সংবর্ধনা জানায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো পাকিস্তানের কারাগারে। বিশ্বের সব প্রধান গণমাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বন্দিত্ব নিয়ে ব্যাপক প্রচার চলতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান এ ব্যাপারে প্রখর নীরবতা অবলম্বন করে। বলা বাহুল্য, ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। আত্মসমর্পণের চার দিন পর, ২১ ডিসেম্বর, প্রথমবারের মতো শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন।
৯ মাসের বন্দিজীবন শেষে বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। সেদিনই তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ)-এর একটি বিশেষ ফ্লাইটে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানান বলে রেডিও পাকিস্তান খবর প্রচার করে।
৮ জানুয়ারি লন্ডনের ক্লারিয়জ হোটেলের এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক ও রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি যখন পাকিস্তানের কারাগারে ‘কনডেম সেলে’ ফাঁসিতে ঝুলবার অপেক্ষায় ছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ তখনো আমাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে।” এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোলান্ডসহ পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো এবং একই সঙ্গে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সকে বাংলাদেশের সমর্থনে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে ধন্যবাদ জানান বঙ্গবন্ধু।
লন্ডনে প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের সময় বঙ্গবন্ধু ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বৈঠক করেন। ৯ জানুয়ারি হিথরো থেকে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য এবং শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জাতির পিতাকে ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা জানান। ২১ বার গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়, ওড়ানো হয় বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা। বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত।
বঙ্গবন্ধুকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, The emergence of independent Bangladesh is itself a unique event in the annals of democratic movements in world history. You have truly been acclaimed the Father of the new nation, Bangladesh.
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সমর্থনের জন্য ভারতের জনগণ, সরকার, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। এর কয়েক ঘণ্টা পর ঢাকায় পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু।
পাকিস্তানের কারাগারে থেকেও যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের যিনি রাষ্ট্রপতি, সেই প্রাণপ্রিয় নেতাকে মুক্ত স্বদেশে স্বাগত জানায় লাখো উদ্বেলিত মানুষ। সব রকমের নিরাপত্তাবেষ্টনী উপেক্ষা করে লাখো মানুষ ঢুকে পড়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ব্রিটিশ বিমানটি থামার পর তাঁকে ঘিরে রাখে উদ্বেলিত জনতা, একজন নবীন সংবাদকর্মী হিসেবে, যা দেখার সৌভাগ্য হয় আমার।
মাটিতে অবতরণ করার আগে বঙ্গবন্ধু বিমানের জানালা দিয়ে তাঁর প্রাণপ্রিয় ‘সোনার বাংলা’ দেখেন, মুক্ত স্বদেশ দেখেন, যাকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গোটা মুজিবনগর মন্ত্রিসভা, মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্ব, শীর্ষ ছাত্রনেতারা এবং কয়েকটি দেশের কূটনীতিকসহ লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্বদেশের মাটিতে আবেগময় অভ্যর্থনা জানান। এরপর মোটর শোভাযাত্রায় তিনি রমনা রেসকোর্সে পৌঁছেন, যেখানে ৭ মার্চ ১৯৭১ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তিনি।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বাংলার স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন দান ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।—ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাঁকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন।’
পাকিস্তানের সামরিক আদালতে যে বিচার প্রহসন চালানো হয়েছিল, হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে তাঁর বহুলালোচিত সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে বলেন : দেশদ্রোহিতা, পাকিস্তান ও তার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে স্বাধীন করাসহ ১২টি অভিযোগ আনা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ফাঁসিতে ঝোলানোর সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি এ-ও বলেন, কারাগারের পাশেই তাঁর কবর খোঁড়া হয়েছিল।
ভারতে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে যান বঙ্গবন্ধু ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখ লাখ মানুষের সামনে ভারতের সর্বস্তরের মানুষ ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। মঞ্চে উপবিষ্ট ইন্দিরা গান্ধীকে লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনাকে মোবারকবাদ জানাই বেশি করে শ্রীমতি গান্ধী, আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়েছিল, আমাকে ফাঁসি দেবার জন্য তারা সমস্ত কিছু ঠিক করে ফেলেছিল, আমি জানি আপনি দুনিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। আপনি দেশে দেশে ঘুরেছেন, আমার দুঃখী মানুষের জন্য, ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য। সে জন্য আপনাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সেদিন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন একই দিনে। সেদিনকার রেসকোর্স ময়দানে ভারত নেত্রী বলেন, I salute the gallant men who have fought this battle, for it is their sacrifice and courage that has brought you freedom. মিসেস গান্ধী আরো বলেন, Today is specially auspicious, because it is the birthday of the leader of your nation, who suffer from injustice or from tyranny. To Sheikh Mujibur Rahman, I offer congratulations and good wishes on my own behalf and on behalf of the government and the entire people of India .
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের নেতৃত্ব গ্রহণের ঘটনাটি ছিল জাতীয় ইতিহাসের আশীর্বাদ। এর ফলে মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ সংকট দূর হয়, মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রসংবরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি দ্রুত সম্পন্ন হয়, যা যুদ্ধ-পরবর্তীকালের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তাঁরই আহ্বানে মাত্র দুই মাসের মাথায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে নতুন যাত্রাপথ নির্মিত হয়। একের পর এক সুচিন্তিত পদক্ষেপে তিনি নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণে সচেষ্ট হন, শুরু করেন তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’, যার সফল বাস্তবায়ন ঘটেনি। তাঁরই নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি ঘটে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং ‘ওআইসি’ বা বিশ্ব ইসলামী জোটের সদস্য হয় বাংলাদেশ।
কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বসে থাকে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পরিকল্পিতভাবে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো হয় এবং অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করা হয়। বলা যায়, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকেই স্বাধীনতার শত্রুরা নতুন রাষ্ট্র ও তার জনককে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। তারই পরিণতি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply