একটি বিখ্যাত উক্তি আছে এমন- ‘অর্থনীতি একটি বন্দুক। আর রাজনীতি জানে কখন ট্রিগার টানতে হবে।’ দেশে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে তাহলে কী রাজনীতিই একমাত্র সমাধান? ২০২৩ সাল বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের বছর। সদ্য বিদায়ী বছরের শেষ দিনগুলোতে বিবদমান দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থানে যে রাজনৈতিক উত্তাপ মাঠে গড়িয়েছে, তা ২০২৩ সালে আরো বেশি জেঁকে বসার আশঙ্কাই এখন জোরালো হচ্ছে। নির্বাচনী সঙ্কটের সুরাহার কোনো আলামত রাজনীতিতে নেই, এমনকি সেই ধরনের কোনো উদ্যোগও টের পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারবিরোধী দলগুলো আবারো আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে। তাদের একমাত্র টার্গেট বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করা। কিন্তু বিরোধীদের এই দাবি গত দুইটি জাতীয় নির্বাচনের মতোই উড়িয়ে দিচ্ছে সরকার। বিরোধীদের আন্দোলন সক্ষমতা কিংবা রাজনৈতিক চাল সরকারের এই দৃঢ় অবস্থানকে কতটা নাড়া দিতে পারবে, সে দিকেই নতুন বছরে চোখ থাকবে সবার। শঙ্কা সংশয়ের মাঝেও নির্বাচনী বছর ২০২৩ কে স্বাগত জানাচ্ছে দেশবাসী।
বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির দিকে নজর রয়েছে বহির্বিশে^রও। ২০২৩ সালে এই নজরদারি আরো বাড়তে পারে। বিগত দুইটি জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালী বেশ কিছু দেশ ও সংস্থা আগামীতে বাংলাদেশে একটি ‘নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন দেখতে চায়। নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর এক ধরনের প্রচ্ছন্ন চাপও ইতোমধ্যে তৈরি করেছে তারা। এই চাপ নতুন বছরের রাজনীতির গতিবিধিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে মীমাংসা না হওয়ায় ভোট যতই এগিয়ে আসবে, ততই রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়বে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। সাধারণ মানুষের আশঙ্কাও এমনই। ২০২৪ সালের জানুয়ারির শুরুতেই নির্বাচনের পরিকল্পনা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। ফলে ২০২৩ সাল জুড়েই রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতায় সরগরম থাকবে রাজপথ। হতে পারে সঙ্ঘাত-সহিংসতা।
নির্বাচনের আর এক বছর বাকি বলে ২০২২ সালটি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর ঘর গুছিয়ে প্রস্তুতি নেয়ার বছর। বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন জোরদারে মনোযোগ দিয়েছে। এই লড়াইয়ে মিত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে তারা।
অন্য দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবেলা এবং নির্বাচনের জন্য দলকে শক্তিশালী করতে গত ২৪ ডিসেম্বর সেরে নিয়েছে তাদের দলের জাতীয় সম্মেলন। দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাল্টাপাল্টি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে, যার উত্তাপ টের পাওয়া গেছে গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় এক সমাবেশ ঘিরে। ওই সমাবেশ ঘিরে সঙ্ঘাত এবং একজনের মৃত্যু নতুন বছরে রাজনীতি উত্তপ্ত হওয়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই মেরুতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আর জাতীয় পার্টি জর্জরিত গৃহবিবাদে। নির্বাচনী রাজনীতিতে সরকার এই দলটিকে ফের ব্যবহার করতে পারে বলে অনেকের ধারণা। জাতীয় পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক গতিবিধি সেদিকেও এগোচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
নতুন বছর বিএনপির অগ্নিপরীক্ষা : আন্দোলন ও নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন বছরে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে বিএনপি। বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, ২০২৩ সাল তাদের জন্য কঠিন এক বছর। সরকারবিরোধী সব দলকে সাথে নিয়ে চলমান আন্দোলনকে চূড়ান্ত সফলতায় নিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প তাদের হাতে নেই। তারা বলেছেন, আন্দোলন দমাতে সরকার আরো কঠোর হবে এতে সন্দেহ নেই। এমনটা ধরে নিয়েই তাদের মাঠে থাকতে হবে। কারণ এবারের আন্দোলনে ব্যর্থ হলে নেতাকর্মীদের চরম মাশুল দিতে হতে পারে। রাজনৈতিক ময়দানে টিকে থাকাই হবে কঠিন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী কয়েক মাস শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেই থাকবে বিএনপি। ১১ জানুয়ারি সব বিভাগীয় শহরে চার ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে এরপরও হরতাল অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাবে না দলটি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক মাস আগ থেকেই আন্দোলনের গতি বাড়ানো হবে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে সরকার একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেই চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে তারা। ১০ দফা তখন এক দফায় পরিণত হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ২০২৩ সাল শুধু আমাদের নয়, এ দেশের মানুষের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যাশা দেশের মানুষ এ বছর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে। বাকস্বাধীনতা, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনবে। ভঙ্গুর অর্থনীতিকে মেরামত করে একটা স্থিতিশীল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা হবে এ বছর। তিনি বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে এ প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সেজন্যই আমরা ১০ দফা দিয়েছে। যার প্রথম দফাই হচ্ছে সরকারের পতন। আশা করি এ বছর জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক জনস্বার্থে আমরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি।
বিএনপির সূত্র জানায়, নতুন বছরে দলটি সরকার পতন আন্দোলনকে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। অলআউট মাঠে নামার আগে সরকারবিরোধী দলগুলোর সাথে ঐক্য আরো সুদৃঢ় করা হবে। নিজেদের মধ্যে যাতে দূরত্ব সৃষ্টি না হয় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অনেক দলকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বাগিয়ে নেয়া হতে পারে। তাই সরকারের কোনো প্রলোভনে যাতে কেউ না পড়ে সে ব্যাপারে বিশ^াস ও আস্থার জায়গা তৈরি করা হবে। এ লক্ষ্যে সমমনা অনেক ছোট দলের আবদারকে বিএনপি গুরুত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, মাঠের আন্দোলনে প্রধান শক্তি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। বাকি দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি ততটা নেই। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই তাদের পাশে রাখা হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ এমনকি বিদেশীদের কাছে একটা বার্তা যাবে যে সরকারবিরোধী প্রায় সবদল একই প্লাটফর্মে রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে যুগপৎ আন্দোলনে সব দলকে একসাথে মাঠে রাখবে বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, রাজপথে আন্দোলনে মামলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে সরকার। দলের সক্রিয় নেতাদের গ্রেফতার করা হতে পারে। ইতোমধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে সাংগঠনিকভাবে কিছুটা হলেও চাপে পড়েছে দলটি। এ চাপ সামনে আরো বাড়তে পারে। তাই নেতাদের গ্রেফতার করা হলেও নেতৃত্ব শূন্যতায় যাতে আন্দোলনের গতি থমকে না যায় সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে হাইকমান্ড। তৈরি করা হচ্ছে কয়েক স্তরের নেতৃত্ব।
একই কায়দায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ : টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের তৃণমূল পর্যায়ে এখন নানা কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এমপি আর স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্বও বাড়ছে। দৃশ্যমান কিছু বড় উন্নয়ন তুলে ধরে গত এক দশক ধরে আওয়ামী লীগ সাফল্যের গান গাইলেও করোনা মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব তাতে বেশ ভালো করেই বাদ সেধেছে। সাধারণ মানুষ এখন দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে জর্জরিত। তারা স্বস্তি খুঁজছে। তবে এমনসব পরিস্থিতি সামলে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। ইতোমধ্যে দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ২০২২ সালের শেষে কেন্দ্রীয় সম্মেলন করেছে তারা।
সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কমিটিতে কোনো পরিবর্তন আনেননি সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় প্রধান হিসেবে দশম বার তার নির্বাচিত হওয়াটা সবারই জানা ছিল। পরিবর্তন না আনার কারণে সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদের টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পেয়েছেন। কমিটির অন্য পদগুলোতেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, আগামী দিনের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অভিজ্ঞদেরই দলে রাখা হয়েছে।
বিরোধীদের মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে। সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সারা দেশে পর্যায়ক্রমে সমাবেশ করছেন। জেলা পর্যায়ে সংগঠনিক ইউনিটগুলো ঢেলে সাজানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সরকারবিরোধী যেকোনো আন্দোলন শক্ত হাতে মোকাবেলার কথাই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।
প্রশাসনের ওপর আওয়ামী লীগের শক্ত দখল থাকায় আগামী দিনে বিরোধীদের দমন কৌশল হতে পারে তাদের দিয়েই। ইতোমধ্যে সেই আলামত দেখা গেছে। সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার গতি বেড়েছে। বেড়েছে গ্রেফতার অভিযান। মামলা ও গ্রেফতার কৌশলের পাশাপাশি সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে সরকার বিরোধীদের দমিয়ে দেয়ার আরো শক্তিশালী প্রচেষ্টা নেয়া হতে পারে নতুন বছরে।
নতুন বছর শুরুর আগমুহূর্তে বিএনপির তরফ থেকে যে গণ-অভ্যুত্থানের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে তার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের বস্তুগত দিক এখন দেশে নেই। দেখতে দেখতে সরকারের ১২ বছর চলে গেল, কিন্তু আন্দোলন হবে কোন বছর। জনগণও এখন আপনাদের আন্দোলনের কথা শুনলে হাসে।’ তিনি বলেন, ‘দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলে প্রাধান্য পাচ্ছে না। তাই বিএনপিকে বলি নতুন বছরে ইতিবাচক রাজনীতিতে ফিরে আসুন।’
নতুন বছরে দেশের রাজনীতিতে অর্থবহ সমঝোতা দেখতে চান রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মাঝে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশকে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। আর বাংলাদেশ কেন্দ্র করে পরাশক্তির মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা সতর্কতার সাথে সামাল দিতে হবে। বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই পরাশক্তির ‘শক্তি পরীক্ষার মাঠে’ পরিণত না হয়।
Leave a Reply