প্রয়োজনানুসারে সরকারের ঋণের জোগান দিতে পারছে না বাণিজ্যিক ব্যাংক। এ কারণেই সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে ঋণ না নিয়ে বরং ফেরত দেয়া হয়েছিল ৯ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশি হারে ঋণ নেয়ায় মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো উসকে যাবে। আর জনদুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল সোমবার নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের টাকার সঙ্কট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে জোগান দেয়া হয়। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতি কার্যকারিতা হারায়। তিনি বলেন, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। কমছে না সরকারের ব্যয়। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এ জন্য সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে, অন্যথায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, নানা কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। প্রথমত, সরকার বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সঞ্চয়পত্র থেকে কাক্সিক্ষত হারে ঋণ পাচ্ছে না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্র থেকে প্রকৃত ঋণ পাওয়া গেছে ৩৩০ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগের চেয়ে উত্তোলন হয়েছে বেশি। ওই মাসে উত্তোলন বেশি হয়েছে প্রায় ৭১ কোটি টাকা। অপর দিকে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপো ও বিশেষ রেপোর মাধ্যমে ধার নেয়া হচ্ছে। বিশেষ রেপোর মাধ্যমে ঋণ নিতে ব্যাংকগুলোকে প্রায় পৌনে ৯ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হচ্ছে। অপর দিকে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় এবং নগদ টাকার ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলো বেশি সুদে আমানত গ্রহণ করছে। কিন্তু সরকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে না। ট্রেজারি বিল ও বন্ড নিলামের দিন ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কাক্সিক্ষত হারে ঋণ পাওয়া যায় না। এ দিকে ব্যাংকগুলো সরকারের ঋণ গ্রহণের কর্মসূচি (অকশন ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী ব্যাংক ও সরকারের ঋণ দিতে বাধ্য ব্যাংকগুলো (প্রাইমারি ডিলার বা পিডি) টাকার সঙ্কটের কারণে ঋণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকারের ঋণের জোগান দিতে হয়। আর এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের হার বেড়ে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বাজারে সরাসরি মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ হট মানি নামে পরিচিত। এক টাকা ছাড়লে ৫ গুণ মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো হয়। আর মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেয়া হয়। কিন্তু ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করতে না পেরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এনবিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অক্টোবরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে আমদানি শুল্ক কমে যাওয়া। ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাক্সিক্ষত হারে এলসি খুলতে পারছে না। এতে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে পণ্য আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যেখানে ৪৮ শতাংশ, সেখানে এবার একই সময়ে পণ্য আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র প্রায় ১২ শতাংশ। পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক কমে গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৭ হাজার ৩০৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯০ হাজার ৯০১ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় হাজার ৪০৪ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। খাতভিত্তিক রাজস্ব আদায়ে পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমদানি ও রফতানি থেকে চার মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪ হাজার ৭৩৯ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২৯ হাজার ৯৩৬ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আদায় হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এ দিকে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় আয়কর আদায়ও কমে গেছে। এনবিআর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আয়করে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক হাজার ৫৬১ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। চার মাসে এই খাত থেকে এসেছে ২৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এই আয় গত অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। সবমিলেই রাজস্ব আদায় কমে গেছে। আবার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদেশী ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই ব্যয় ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতির হার আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। আগস্টে তা বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সেপ্টেম্বরেও এ হার ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। অক্টোবরে তা কিছুটা কমে ৯ শতাংশের নিচে নামে। তবে মূল্যস্ফীতির এ হিসাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যখন বাজারে পণ্যমূল্য আরো বেড়েছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে তখন মূল্যস্ফীতির হার কিভাবে কমল এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে সাথে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের হার কমে যাবে বলে তারা মনে করেন।
Leave a Reply