বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল এশিয়ার অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি। ভূপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকেও রয়েছে এ অঞ্চলের যথেষ্ট খ্যাতি। হাওর একটি প্রাকৃতিক জলাশয়। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও বৃহত্তর সিলেটের একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে হাওর। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ওপর থেকে নেমে নিম্নাঞ্চলের দিকে আসবে, ওই পানি হাওরকে বছরের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জলমগ্ন রাখবে আবার চলে যাবে- এটিই প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু হাওরে বসবাসকারী মানুষের জীবন যেন পানিবন্দি সময়ের মতোই আটকে আছে অসহায়ত্বের এক চক্রের ভেতর। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ব্যক্তিপর্যায়ে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন, ফল-ফসল আবাদের জন্য ছোট-বড় বাঁধ নির্মাণ- এই বিষয়গুলো যে পাঁচ দশক ধরে হাওরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত করেছে, এতে সন্দেহ নেই। এক কথায় এটিকে আমরা বলতে পারি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই হাওরে চলছে অসময়ের বৃষ্টি ও বন্যার ঢল।
হাওরে সাধারণত একটা ফসল। সাত-আট মাস পানিবন্দি থাকার পর অক্টোবর-নভেম্বরে পানি নেমে গেলে শুরু হয় কৃষিকাজ। এ অঞ্চলে কৃষি মানেই ধান চাষ। এই একটি ফসলে এ অঞ্চলের কৃষকের সারাবছরের রোজগার। ওই ফসলও যদি আগাম বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়, তা হলে তাদের আর কিছুই থাকে না। অথচ সামনে থেকে যায় দীর্ঘ একটি বছর অর্থহীন, খাদ্যহীন। প্রতিবছরই এপ্রিল-মে মাসে গণমাধ্যমের খবর হয়ে আসে হাওর অঞ্চল। কৃষকরা অভিযোগ করেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কারণে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে তার প্রাণের ফসল।
মনে পড়ছে, ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের হাওরের বিস্তীর্ণ বোরো ফসল। সরকারি হিসাবে বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। ওই বছর ফসলহানির পর পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর পর বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধের কাজ করানো হয়। কিন্তু এতেও কৃষকের দিন ফেরে না। অনিয়মের বাঁধ এত শক্ত যে, তা ভেঙে বরাদ্দ কৃষকের মাঠে পৌঁছায় না। জমির বাঁধ আর শক্ত হয় না, বছর বছর বন্যায় ভেঙে পড়ে।
হাওরের মানুষ এখন দুষ্টুচক্রে আটকে আছে। তাদের অবস্থা হয়েছে ডাঙায় বাঘ জলে কুমিরের মতো। একে তো ঠিকমতো বাঁধ না দেওয়ায় জমির ফসল তলিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জলাভূমিগুলোও দখলে আছে ক্ষমতাবানদের। ফলে জমির ফসল ও জলের মাছ- কোনোটিই জুটছে না কৃষকের কপালে। আবার একদিকে ক্ষুদ্রঋণের নাম করে এনজিওগুলো বিছিয়েছে ঋণের জাল। ওই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে নিতে হচ্ছে মহাজনী ঋণ। ঋণের এ জাল ছিঁড়ে কৃষকদের বের করে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। আমি মনে করি, শুধু বাঁধ নির্মাণ করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সারাবছর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ধান-মাছের বাইরেও বিকল্প অর্থনীতি দাঁড় করাতে হবে। সম্প্রতি পর্যটনের জন্য এই অঞ্চল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্পে এই অঞ্চলের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
এবার আসি কৃষির কথায়। ধান চাষের বাইরে প্রাকৃতিক মাছের বড় একটি ক্ষেত্র এই হাওর। আফালের কারণে হয়তো খাঁচায় মাছ চাষ কঠিন হয়ে যাবে। তবে স্থায়ী কাঠামো তৈরি করে মাছ, ঝিনুক ও শৈবাল চাষ করা যায় কিনা- এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা প্রয়োজন। কৃষির বিকল্প খাত তৈরি করার মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষকে বছরব্যাপী আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ধানের কথা বলতে গেলে দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে আমাদের রয়েছে লবণ, খরা, বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত। তবে সময় এসেছে এই জাতগুলোর সহনশীল ক্ষমতা আবার পরীক্ষা করার। প্রয়োজনে নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সময় জয় করে চলতে হবে। যে কোনো বিপদের আগাম দিকটিও মাথায় রেখে এসব প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। যেমন- কার্তিকে যে মঙ্গা হতো দেশের উত্তরাঞ্চলে, সেটিকে প্রতিহত করা গেছে একাধিক স্বল্পমেয়াদি (ঝযড়ৎঃ উঁৎধঃরড়হ ঠধৎরবঃু) ধানের জাত দিয়ে। ব্রি ধান-৩৩, ৩৯ ও বিনা ধান ৭- এগুলো আগাম জাতের স্বল্পমেয়াদি ধান। তা কার্তিক আসার আগেই কৃষক ঘরে তুলতে পারেন। নতুন জাতের এ ধানটি দিয়ে মঙ্গা জয় করেছেন স্থানীয় কৃষক। এ সফলতা দেখিয়েছেন আমাদের ধানবিজ্ঞানীরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাওর অঞ্চলের জন্য স্বল্পমেয়াদি বোরো ধানের কোনো জাত আছে কিনা? আমার জানা মতে নেই।
ষাট, সত্তর ও আশির দশকে কৃষক আইআর-৮ জাতের ধান চাষ করতেন হাওর অঞ্চলে। এর মেয়াদকাল লাগানোর পর থেকে কাটা পর্যন্ত ১৭০ দিন। পরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিআর-২৮ ও ২৯ জাত বোরো মৌসুমের জন্য উফশী জাত হিসেবে চাষ করলেন কৃষক। বিআর-২৮ লাগানোর পর থেকে ১৪০ দিন এবং ১৬০ দিনে বিআর-২৯ ফসল কাটা যায়। সাধারণত হাওরের কৃষক বিআর ২৮-এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন বেশি। কারণ আগাম বন্যার পানি আসার আগেই তারা ফসল তুলতে পারেন।
চলতি বছরের বিপর্যয়ের আগে বিগত বছরগুলোয় অন্যান্য যে ফসল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলো প্রধানত বাঁধ ভেঙে গিয়ে ফসল তলিয়ে যাওয়া এবং কখনো কখনো অতিআগাম বন্যা। এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাজাহান কবীরের সঙ্গে। তিনি জানান, হাওরে সাধারণত বোরো মৌসুমের ফসলই ফলে। এ ক্ষেত্রে ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধান কৃষকের বেশি পছন্দের। এ দুটি জাতই ১৪০ থেকে ১৬০ দিনে ফসল কাটা যায়। ব্রি ২৮-এর স্থলে ব্রি-৬৭, ব্রি-৮১, ব্রি-৮৪ এবং ব্রি-৯৬ নতুন জাত। আর ব্রি ২৯-এর বিকল্প হতে পারে ব্রি-৯৮, ব্রি-৯২ এবং ব্রি-১০২। কিন্তু এগুলোরও ফসল কাটতে ১৪০ দিন লেগে যাবে। আমার প্রশ্ন ছিল, মেয়াদ না কমলে নতুন জাতে লাভটা কী হবে? তিনি জানান, নতুন জাতগুলো কিছুটা ব্লাস্টরোধী।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট হাওরের আগাম বন্যার কথা ভেবে নতুন ধানের জাত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমন ও আউশের জন্য ১০০ থেকে ১১০ দিনে ফসল কাটা যায়- এমন স্বল্পমেয়াদি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। বোরো মৌসুম যখন শুরু হয়, তখন এ দেশে শীতের শেষ ভাগ। বোরো ধান লাগানোর সময় নিম্ন তাপমাত্রা থাকে। অন্যদিকে বীজতলায় ২০ থেকে ২৫ দিন বয়সী চারাগুলো শীতের কারণে কখনো কখনো কোল্ড ইনজুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পরে ধান হলেও তা চিটা হয়ে যায়। এ রকম অনেক কারণেই এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ সত্যি সত্যিই দুরূহ। অন্যদিকে এ কথাও ঠিক, নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করতে সময় লেগে যায় ১০ থেকে ১৫ বছর। সেদিক থেকে যে গতিতে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, ওই গতিতে পরিবর্তিত এ জলবায়ু জয় করার জন্য প্রয়োজনীয় যে সময় লাগছে- গবেষণা এই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা দেশের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে বসবাস করতে গিয়ে জনমানুষ নানাভাবে হাওরের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- হাওরের জীববৈচিত্র্যের জন্য হয়ে উঠছে হুমকিস্বরূপ। উন্নয়নের নামে হাওরের স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যেমন যাবে না, তেমনি হাওরের মানুষকে উন্নয়নের মূল স্রােত থেকে দূরে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তাই হাওরের জন্য ভাবতে হবে অন্য রকম করে। কীভাবে হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণœ রেখে মানুষকে উন্নয়নের ধারায় যুক্ত করা যায়, এ জন্য নিতে হবে সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ।
শাইখ সিরাজ : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
Leave a Reply