সময় নিরন্তর বহমান। আপনি শুয়ে-বসে আলস্যে দিন পার করুন কিংবা হাসি-তামাশা-আড্ডায় গা ভাসিয়ে দিয়ে কাল কাটান সময় তার আপন গতিতে বয়ে চলবে। আপনি যেভাবেই সময়কে বইতে দিন না কেন ঘড়ির কাঁটা, ক্যালেন্ডারের পাতা কিংবা পঞ্জিকার একেকটি সংস্করণ ফুরিয়ে যাবে আপন নিয়মে। তাতে আপনার জীবনের একেকটি দিন, মাস-বছর ফুরিয়ে যাবে কিন্তু তা কতটুকু সাফল্যে ভরিয়ে তুললেন নাকি ব্যথতায় পর্যবসিত হলো সেই অর্জন বা তার দায়ভার সম্পূর্ণই আপনার।
সময়কে যদি কাজে লাগাতে পারেন তা হলে এর অর্জন যেমন আপনাকে সমৃদ্ধ করবে, তেমনি একে অবহেলায় বইয়ে দিলে ব্যর্থতার গøানি যন্ত্রণাময় করে তুলবে জীবন।
অযতনে সময় পেরিয়ে যেতে দিলে পরে অনুশোচনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আর অসময়ের অনুশোচনা ও হা-হুতাশ কিছুই পাল্টাতে পারে না। এ জন্য সময়ের কাজ সময়েই করতে হবে। সময়কে কাজে লাগিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে, মূল্যবান করতে হবে। এর জন্য প্রতিটি মুহূর্তকেই গুরুত্ব দিতে হবে। একটি মুহূর্ত সময়ও অকারণে, বিনা কাজে চলে যেতে দেয়া যাবে না। জানতে হবে সময়কে মূল্যবান করে ধরে রাখার উপায়।
ছাত্রজীবনে সবাই কমবেশি ‘সময়ের মূল্য’ রচনাটি মুখস্থ করে থাকে। রচনা লিখন আমাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ জন্য যে, এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। জীবনের নানা দিক সম্পর্কে তারা বৃহত্তর পরিসরে ভাবতে শেখে। ‘সময়ের মূল্য’ তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়Ñ আমাদের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই অন্য সব বিষয়ের মতোই এই রচনাটিও নিছক মুখস্থ বুলির মতোই আওড়ে যায়। পরীক্ষার খাতায় নম্বর অর্জনই এর একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেয়। এটি মুখস্থ বিদ্যার অভিশাপের একটি অংশ।
চলমান বৈশ্বিক মহামারীর কারণে আমাদের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে নিঃসন্দেহে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অভিভাবকদেরই উচিত তাদের সময় দেয়া। যতœ-মনোযোগসহকারে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের যথাসম্ভব পড়াশোনার ঘাটতি কমিয়ে আনা।
তবে আজকের এ নিবন্ধ সময়ের ব্যবহার সম্পর্কে তরুণদের উদ্দেশে কিছু বক্তব্য তুলে ধরার মধ্যেই সীমিত রাখতে চাই। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে শিক্ষায়তনসহ প্রায় সব কিছুই দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। লকডাউন না থাকলেও ব্যবসায় বাণিজ্যে মন্দার কারণে করপোরেট হাউজগুলোতে কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না সেভাবে। ফলে তরুণদের পড়াশোনার সাথে সাথে নিয়োগ বা কাজের সুযোগও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। সব কিছু বন্ধ থাকলেও সময়ের চাকা কিন্তু একটুও বন্ধ নেই। দুনিয়ায় যা কিছুই ঘটুক না কেন সময় তার অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলমান থাকবেই। ফলে আমাদের তরুণদের জীবন থেকে অত্যন্ত মূল্যবান অংশ বিফলে যেতে বসেছে।
এ অবস্থায় তরুণদের সময়ের ব্যবহার সম্পর্কে সর্তক হতে হবে। তাদের খুবই গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করতে হবে যে, সময়ের সমষ্টিই আমাদের জীবন। মহামারীর কবলে পড়েছি বলে একেবারে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে এই অতি মূল্যবান সময়কে বিফলে যেতে দেয়া যাবে না।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থী বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা তরুণদের একটি বড় অংশ এই মহামারীর ফলে চরম হতাশায় ভুগছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে হতাশায় ভেঙে পড়া তরুণদের জন্য মোটেও কাম্য নয়। জীবন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। আজ যেমন বৈশ্বিক মহামারী চলছে, তেমনি কোনো কোনো দেশের তরুণদের জন্য গৃহযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ, সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন কিছু বিষয় তাদের জীবনের গতি থমকে দেয়। আমাদের প্রায় বছরব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধও ছিল এরকমই একটি বিষয়। এরকম অস্বাভাবিক ও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মোকাবেলা আমাদের করতে হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা আর প্রজ্ঞার সাথে কাজ করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার উৎকৃষ্ট সময় তার।’
যুবসমাজকে মনে রাখতে হবে, পরিস্থিতি যত প্রতিক‚লই হোক না কেন, মহান স্রষ্টা একটি না একটি পথ আমাদের জন্য খোলা রাখবেনই। সর্বশক্তিমানের ওপর ভরসা করে সেই পথটি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ‘পরিস্থিতি খারাপ চলছে’, ‘সব কিছু থমকে আছে’ এই অজুহাতে সময়কে তার নিজের গতিতে চলতে দিয়ে পরিস্থিতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ কোনো সচেতন তরুণের জন্য শোভনীয় নয়। তারুণ্যের শক্তি আর দৃঢ়তা দিয়ে রুখে দিতে হবে সময়ের গতি। সময় যেমনিভাবে চলছে তাকে সেভাবে চলতে দিলে নিজের চরম সর্বনাশই ডেকে আনা হবে। একজন বুদ্ধিদীপ্ত তরুণের কাছে তার পরিবার, সমাজ বা দেশ কেউই এমন অসহায়ত্ব চায় না। সময়কে তার মতো চলতে না দিয়ে নিজের মতো করে তাকে কাজে লাগাতে পারলেই সময় হয়ে উঠবে মূূল্যবান। আর সেটি সম্ভব মহামারী, অতিমারী, লকডাউন বা যেকোনো দুর্যোগের মধ্যেও।
বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোতে আমাদের দেশের দক্ষ তরুণদের জন্য অসংখ্য কাজের সুযোগ রয়েছে। সেই দক্ষতা অর্জন করতে হবে। চলমান এই বৈশ্বিক স্থবিরতা সব কিছু বন্ধ করে দিলেও ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। এই ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল যোগাযোগের পথ ধরেই এগিয়ে যাওয়া যায় বহুদূর। বিদেশে বা দেশেই ভালো কিছু করার জন্য বিভিন্ন বিদেশী ভাষা শিক্ষা হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্ত্র। ইংরেজি একটি প্রধান আন্তর্জাতিক ভাষা। এটিএমস ও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইংরেজি ভাষা শেখাসহ আরো কিছু উচ্চতর কোর্স চালু রেখেছে। মহামারী এ সময়টাতে এরকম কিছু প্রশিক্ষণ বদলে দিতে পারে জীবনের গতি। কম্পিউটারের বিভিন্ন কোর্সও করা যেতে পারে। ই-কমার্স, ই-লার্নিং এরকম অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ তরুণদের তাদের সময়কে কাজে লাগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। বিশ্বজুড়ে অনলাইনভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং কাজের ব্যাপক সুযোগও রয়েছে অবারিত। এ সবের কোনো একটি শিখে নিজের সময়কে কাজে লাগানো বা নিজেকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব।
করোনার এই দুঃসময়কে অভাবনীয় সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিশ্বে অনেকেই নতুন ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন তাদের বুদ্ধি, প্রজ্ঞা আর সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে। আমাদের তরুণদেরও এই সফল ব্যক্তিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দুঃসময়ের মধ্যেও নতুন কিছু করার সুযোগ খুঁজে নিতে হবে। এর জন্য নিজের বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, অনুসন্ধিৎসা আর সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে পরম ধৈর্যের সাথে।
এছাড়া টিভি বা কম্পিউটারে মুভি দেখে বা বন্ধুদের সাথে অপ্রয়োজনীয় আড্ডাবাজিতে সময় নষ্ট না করে ঘরে বসে বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞানার্জনের সাধনায় সময়কে কাজে লাগানো যেতে পারে। বিশেষ করে গণিত বা বাংলা-ইংরেজি গ্রামারের কঠিন এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো এই সময়ে ভালো করে অধ্যয়ন করা যেতে পারে, যা নিজের দুর্বলতাটুকু কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো জীবনেরই একটি অংশ। তবে অবশ্যই সেটি সীমিত করা উচিত। হয়তো দুয়েকজনের অবিবেচক আড্ডাবাজির কারণে অন্য বন্ধুদের মূল্যবান সময়ের অপচয় হয়ে যেতে পারে, যারা সময়কে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে চান।
তরুণদের সবারই কোনো না কোনো স্বপ্ন থাকে। যুব-তরুণরা প্রকৃতিগতভাবেই ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত। তবে পরিকল্পিতভাবে সময়কে কাজে না লাগালে এই স্বপ্ন মরীচিকার মতোই অধরা থেকে যাবে। অযথা দিবাস্বপ্ন দেখা বা সেই স্বপ্নের ঘোরে বিভোর হয়ে যাওয়া পরিত্যাগ করতে হবে। আর নিত্যনতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করাও তরুণদের একটি অভ্যাস। স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন সাজানোর পরিকল্পনা রচনা পর্যন্ত শুধু নিজের সক্রিয়তা সীমাবদ্ধ রাখলে সব কিছুই হারিয়ে যাবে।
স্বপ্ন আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যদি আমরা ‘আগামীকাল’ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই তা হলে বর্ণিল স্বপ্নের অপমৃত্যুই ঘটবে। মূল্যবান সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাই সুন্দর আগামীর জন্য প্রতি মুহূর্ত সময়কে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। কাজের ফাঁকে বিশ্রাম মানে সময়ের অপচয় নয় বরং সেটিও সংগ্রামেরই অংশ। যুব-তরুণদের অদম্য কর্মস্পৃহায় জেগে উঠুক স্বপ্নের বাংলাদেশ। সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আজকের তারুণ্য গড়ে তুলুক জাতির এক সমৃদ্ধ সোনালি অধ্যায়। এটিই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও এটিএমস এডুকেশন, ঢাকা
Leave a Reply