আমাদের সংবাদমাধ্যম যথার্থই ‘গণমাধ্যম’ হয়ে উঠতে পেরেছে কি না সে প্রশ্ন তোলার অধিকার ও সুযোগ দু’টিই আছে। সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বাপর কবুল করতেই হবে, মিডিয়া এখন যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, এটি বিশাল এক খোলা জানালা। এ বাতায়নপথে দূর-দিগন্তে দৃষ্টি ছুড়ে দেয়া যায়, পৃথিবীর রূপবৈচিত্র্য অবলোকন করা যায়, অগ্রসরমান বিপদ বা শত্রুর পদধ্বনিও শোনা যায়। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো- সেই জানালা দিয়ে ঝড়োবেগে ঘরে ঢুকে পড়ে ময়লা-আবর্জনাও। যেনতেন ময়লা নয়, কখনো তা আপনার সাজানো-গোছানো পরিপাটি শোবার ঘরটিকে আপনার নিজের কাছেই সম্পূর্ণ অচেনা করে তুলবে। এটি হলো একটি দিক।
আরেক দিকের অবস্থা আরো নাটকীয় এবং শোচনীয়। যেহেতু এ জানালা কেবল দৃষ্টির বহির্বিস্তারণ নয়; বরং এটি কখনো আপনাআপনিই অন্ধত্ব তৈরি করতে পারে। কাজেই এ জানালা কখনো খবরের বাহক হওয়ার পরিবর্তে উৎপাদকও হয়ে ওঠে। কথিত গণমাধ্যমের উৎপাদিত সেই খবরে আপনার সকাল-সন্ধ্যা, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য, উন্নতি-অবনতি, আকর্ষণ-বিকর্ষণ এমনকি জীবন-মরণের প্রশ্নও জড়িয়ে যেতে পারে। আপনি তখন পরিস্থিতির স্রেফ এক অসহায় শিকার ও বোবা দর্শক। মিডিয়ার এক চোখে সত্য ও সুন্দরের আলো; আরেক চোখে থাকতে পারে মিথ্যা, হিংসা ও ধ্বংস-তাণ্ডবের রক্তলাল অগ্নিদৃষ্টি।
এর পরও আপনি যেহেতু একুশ শতকের ‘বিশ্ব নাগরিক’ তাই মিডিয়া থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন কেউ নন। এর ইতিবাচক ও কল্যাণকর দিকগুলোকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও মানবতার খেদমতে অবদান রাখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। অধিকন্তু আপনার বৈরীপক্ষের করতলগত এ হাতিয়ারটির অন্ধি-সন্ধির খোঁজখবর রাখতে পারলেই আপনি ও আপনার সমাজ অধিকতর নিরাপদ।
অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগমাধ্যমের এই অভূতপূর্ব উন্নতি এমন বিদ্যুৎবেগে ঘটছে যে, মানুষের ভাবনাচিন্তা, রুচি-মূল্যবোধ ও মানস-চেতনাকে সম্পূর্ণ কব্জা করে নিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে রেডিও, টিভি, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট এবং ইন্টারনেট প্রভৃতির গুরুত্ব ব্যাপক। আজকের দুনিয়া এসব প্রযুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তথ্য-যোগাযোগের এ মাধ্যমগুলো আমাদের চিন্তা, রুচি, জীবন, সমাজ, অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে।
আমরা জেনে বা না জেনে যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। একসময়ের টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিওর জগৎকে পেছনে ঠেলে দিয়ে প্রিন্টেড ও ইলেকট্র্রনিক মিডিয়া মানুষের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। জনজীবনে এর প্রভাব বিশাল-সুবিস্তীর্ণ।
আলোচনা সামনে এগিয়ে নেয়ার আগে আরেকটি বিষয়ের দিকে আমরা পাঠকের দৃষ্টি ফেরাতে চাই। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিডিয়ার যে অপ্রতিহত প্রভাব, তা নিয়ন্ত্রণ করছে কে? নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ববাণিজ্য সোজা কথায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। সংবাদমাধ্যমের ওপর ওদের নিয়ন্ত্রণ যতই শক্ত হচ্ছে এর কণ্ঠ ততই উচ্চকিত ও জোরালো হতে চলেছে। আর দিন-রাত তার গুণকীর্তন ও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরোক্ষভাবে এসব বহুজাতিক কোম্পানি গোটা মানবগোষ্ঠীকে ইচ্ছেমতো ‘নাকে দড়ি দিয়ে’ ঘোরাচ্ছে। একান্ত অনুগত দাসের মতো পৃথিবীর মানুষ চোখ-কান বন্ধ করে তার পেছনে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে। হোক তা খবর, সংবাদবিশ্লেষণ, নাটক, সিরিয়াল, চলচ্চিত্র কিংবা বিজ্ঞাপন- সব কিছুই এসব বণিক গোষ্ঠীর হাতের মুঠোয়। সংবাদমাধ্যম আর বাণিজ্য যেন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পরস্পরের পরিপূরক। একটি বাদ দিলে অপরটির অস্তিত্ব অসম্ভব। বাণিজ্য যেন গণমাধ্যমের দেহে প্রবাহিত রক্তধারা আর গণমাধ্যমের প্রধান কর্তব্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থের অনুকূলে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিবেদন করা।
গণমাধ্যমের চিন্তাধারার অভিমুখ ও সংবাদের পণ্যায়ন সম্পর্কে ড. মাহফুজ পারভেজের প্রাসঙ্গিক দুু-একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। ‘কোন সংবাদ ছাপলে ভালো বিক্রি হবে এবং পাঠক সানন্দে গ্রহণ করবে তা সর্বদাই বিবেচনা করতে হয় সংবাদ কর্তৃপক্ষকে। এ কারণেই বাজারে গতি-প্রকৃতি বুঝে সংবাদ-কর্তৃপক্ষও পাঠকের উত্তেজক চাহিদাকে সঙ্গ দেয়। ব্যবসায় আর সস্তা জনপ্রিয়তার দ্বৈতচক্রে পর্যুদস্ত হয় সর্বজনীন নৈতিকতা ও চিরায়ত মূল্যবোধ। হলুদ সাংবাদিকতাও সুযোগ নেয় এই পরিস্থিতির। সাথে করে নিয়ে আসে তথ্যসন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চরিত্রের অক্টোপাস।’ (উপসম্পাদকীয় কলাম, দৈনিক পূর্বকোণ, ১১ জুলাই-২০০৯) সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘মানুষ সেখানে পড়বে ও শুনবে মানুষের সমবেত ও মিলিত কণ্ঠস্বর। নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দায়িত্বশীলতা বাদ দিয়ে প্রকৃত মানবকণ্ঠ গুঞ্জরিত হবে না। মিথ্যা, নেতি ও পক্ষপাতের কণ্ঠ হলে সংবাদপত্র ও মিডিয়াও হয়ে যাবে ভীতি, আতঙ্ক ও ঘৃণার পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এক মাতালকণ্ঠ।…জনমানব ও মহাকালের কাছে এদের স্থায়ী ঠিকানা কখনোই হয় না।
মিডিয়ার ইতিবাচক দিক
এ পর্যন্ত আলোচনায় গণমাধ্যমের কিছু নেতিবাচক দিক সামনে এলেও শুরুতেই আমরা এর ইতিবাচক দিকগুলোর প্রতি খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েছি। প্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যম মানুষের জীবনের বহু দুর্লভ প্রয়োজনকে শুধু সুলভই করেনি, বলা যায় মুঠোয় পুরে দিয়েছে। ইন্টারনেটের কথাই ধরা যাক- এটি বর্তমানে ডিজিটাল বিশ্বকোষ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, অধ্যয়ন-গবেষণার জন্য আজকাল আর লাইব্রেরির হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থ উল্টানোর মতো গলদঘর্ম হওয়ার যেমন দরকার হয় না, তেমনি বহুগুণ সাশ্রয় হচ্ছে মানুষের মূল্যবান সময়েরও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আতিপাতি করে কোনো বিষয়ের উদ্ধৃতি খোঁজার পরিবর্তে কি বোর্ডের কয়েকটি বাটন চেপে ১০-১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই তা পেয়ে যাচ্ছেন।
এভাবে ব্যবসাবাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো বিষয় নেই যার সমাধান ইলেকট্রনিক মিডিয়া আপনাকে দিচ্ছে না। ফলে আপনার মিশন সফল করতে, পৃথিবীর মানুষের কাছে আপনার চিন্তাচেতনা ও বিশ্বাসের কথা পৌঁছে দিতে গণমাধ্যমের চেয়ে অধিক কার্যকর আর কোনো হাতিয়ার নেই। আজকের বিশ্বে খ্রিষ্টান ধর্মসহ সব ধর্মাবলম্বী এই চমৎকার সুযোগটি দারুণভাবে কাজে লাগাচ্ছে। মুসলমানরা এ ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে থাকলেও আরবজাহানসহ বিভিন্ন মুসলিম বিশ্বের গবেষকরা এ ক্ষেত্রে কমবেশি তৎপর রয়েছেন। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও এটি আশার কথা। সব কিছুকে ছাপিয়ে মিডিয়া সংস্কৃতির শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
অবাধ তথ্যপ্রবাহ
তথ্য কথাটি তথা থেকে উৎসারিত। তথা মানে- ঠিক তাই। অর্থাৎ যা ঘটেছে হুবহু তাই বিবৃত করা। এই অর্থে তথ্য ‘সত্যের’ সমার্থক। তথ্য যখন তার এই বুৎপত্তিগত অর্থ থেকে সরে দাঁড়ায় তখন তা বিকৃতির নামান্তর। অবাধ তথ্যপ্রবাহের অর্থ দাঁড়ায়- কোনো বাধা-বিপত্তিহীন সত্যের প্রকাশধারা। এটি প্রকাশ ও জানার অধিকার আমাদের সমাজে ‘তথ্য-অধিকার’ বলে পরিচিত। সত্য বলা এবং সত্যটি সবার জানার যে অধিকার রয়েছে, তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা গ্রহণযোগ্য ও শুভ নয়। কিন্তু অবাধ তথ্যপ্রবাহের নামে দিনকে রাত আর সাদাকে কালো হিসেবে উপস্থাপন আদৌ কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর অধিকার হতে পারে না। এই স্লোগান তথ্যসাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার মাত্র। হলুদ সাংবাদিকতার প্রতিরূপ। তাই তথ্যের অবাধ প্রবাহে সততা, দায়িত্বশীলতা ও মানবিকতার বাঁধ দিয়ে এতে ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
আঁধারের মাঝে আলোর মশাল
মিথ্যার রাজত্ব, বিকৃতির জয়োল্লাস, হিংসা ও শঠতার ভ্রূকুটি মাড়িয়ে, অন্ধকারের গাঢ় পর্দা ভেদ করে মাঝে মধ্যে দু-একটি সাহসী উদ্যোগ এবং কিছু অকুতোভয় তথ্যসৈনিককে সত্যপ্রকাশে এবং সুন্দরের চর্চায় চ্যালেঞ্জ নিতে দেখা যায়। সাম্র্রাজ্যবাদী পরাশক্তি, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু, হত্যা, নিপীড়ন তাদের থামিয়ে দিতে পারে না। শত প্রতিকূল ঝড়ো হাওয়ায় খানিকটা পাল ছেঁড়া নৌকার মতো তাদের পথচলা মিথ্যার রাজত্বে ভাঙন ধরাতে না পারলেও কিছুটা কাঁপন ধরায়। সত্যের কাফেলায় শরিক হয়ে যারা জীবন কাটাতে প্রত্যয়ী জনগণের সেই অংশটি ইলেকট্র্রনিক ও প্রিন্টেড মিডিয়ার এমনসব সত্যাশ্রয়ী সাংবাদিকদের পাশে সবসময়।
ইলেকট্র্রনিক ও প্রিন্টেড উভয় মিডিয়ার প্রোগ্রাম ও নিউজগুলোর মূল্যায়ন করলে ইতিবাচক ও নেতিকবাচক দু’টি দিক শনাক্ত করা সম্ভব। দুই জায়গাতেই ভালো-মন্দ দুয়ের দেখা মিলবে। এক দিকে গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত কিছু লোক সমাজের অস্থিমজ্জায় মিশে যাওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন আবার এর বিপরীতে এমনও মানুষ আছেন, যাদের কিছু কাজ সমাজ ও মানুষের জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনছে। জীবনমুখী অনুষ্ঠান ও কল্যাণধর্মী প্রোগ্রাম গুরুত্ব হারাচ্ছে এবং অনুষ্ঠানাদির সার্বিক মান নিম্নমুখী হতে চলেছে। মানুষের মাঝে উত্তেজনা ও একধরনের আসক্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনৈতিক পথ অবলম্বনেও তারা দ্বিধা করে না। তবে অবশ্যই এর ব্যতিক্রম চিত্রও আছে, যার জন্য গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার।
গণমাধ্যম এক দিকে আমাদের সবরকমের সংবাদ সরবরাহ করছে, অন্য দিকে সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের অভ্যন্তরে অন্তঃসলিলার মতো প্রবাহিত হচ্ছে। দুর্নীতি উদঘাটন ও দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচনে বেশ সাহসী ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তবে মাঝে মাঝে তারা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর হাতের পুতুলেও পরিণত হয়। মিডিয়ার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অর্থ জোগানের বেলায় আদর্শিক চ্যালেঞ্জে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলে বেশির ভাগ মিডিয়াকে নৈতিকতার প্রশ্নে আপস করতে দেখা যায়।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট
Leave a Reply