1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২০ অপরাহ্ন

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে করণীয়

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দে বাঙালি ভুলেই গেছে যে আন্দোলনটি ছিল মূলত রাষ্ট্রভাষার জন্য। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতীক। গত দুই দশকে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। বহু পণ্যের ব্যবহারবিধি বাংলায় দেয়া হয়। আমলারা বাংলাতেই তাদের নথি পড়েন এবং বিভিন্ন আদেশ দেন। নিম্ন আদালতে বাংলায় রায় দেয়া হয়। শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও ব্যবসায় জগতে ব্যবহৃত বাংলা জনগণের বোধগম্য কিনা সেই প্রশ্ন না তুলেও বলা যায় যে, বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। বাংলা ভাষায় জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার বিষয়টি উদ্যোগহীনতার ফলে আদৌ উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীন দেশে নিজের মাতৃভাষাকে সঠিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা ও সর্বস্তরে এই ভাষার প্রয়োগের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।

একুশের চেতনা দিয়েই বাঙালি জাতির শুরু। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, যা পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে চূড়ান্তভাবে সেই চেতনার বিকাশ ঘটে। আমরা পাই প্রিয় বাংলাদেশ। আমরা স্বাধীন দেশ পেলাম কিন্তু আজো আমরা নিজের ভাষার চর্চা না করে অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। এ অপসংস্কৃতি, দেশপ্রেমহীনতা ও দুর্নীতি দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। চীন, কোরিয়া, জাপান, জার্মানি, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইরান জাতি নিজের ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, জ্ঞানে আজ দেশগুলো পরাশক্তি। অন্যের ভাষা শিখে এগুনো যে বেশ কঠিন, অথচ সহজ সত্য আজো আমরা বুঝে উঠতে পারলাম না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রকৌশল নিয়ে একটি বিশ্বমানের বাংলা অনুবাদের বই আজো পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পেলাম না। আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করি এটা তাদের জন্য লজ্জার। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। এ ত্যাগের পর সে ভাষা ৫০ বছরে কতটুকু এগোল – এ প্রশ্ন রাখাই যায়। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৮ থেকে ৪০ কোটি বাংলাভাষী মানুষ। আমরা জাতিসঙ্ঘের দাফতরিক ভাষা বাংলা চাই; অথচ নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভালো বাংলা বই প্রকাশ করি না। অতি দ্রুততার সাথে ঘুরে দাঁড়ানো আমাদের প্রধান দায়িত্ব। হয়তো বা একটি সামাজিক আন্দোলন দরকার মাতৃভাষা সর্বস্তরে ব্যবহার ও প্রচলনের।

মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে ভাষা আন্দোলনের ফলেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথ সুগম হয় বলে দাবি করি। স্বাধীন দেশে ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এ দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। এ ইতিহাস বাংলাদেশের অনেকেরই জানা। কিন্তু এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরো অনেক সংগ্রামের ইতিহাস। সে সংগ্রামের চেতনা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

উনিশ শতকের শুরুতে এ ভূখণ্ডে ঘটে নানান পরিবর্তন; বাংলার নবজাগরণের সে এক বিরাট শুভসময়। ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন-মানবতা-ইতিহাস প্রভৃতির প্রভাব ভারতবাসীর জীবনে সামগ্রিকভাবে আমূল পরিবর্তনের হাওয়া বইয়ে দিলো। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সে জলবাতাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; সেসব প্রবণতা আত্মস্থ করেছিলেন বেশ দ্রুত। কবি বঙ্গ বলতে বাংলা ভাষাকে বুঝিয়েছেন; তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য-ভাণ্ডার অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং ঔৎকর্ষমণ্ডিত। তবে তিনি নির্বোধের মতো অন্যের ভাষা-সাহিত্য আয়ত্ত করার এবং তার অনুকরণে সৃজন চর্চার আকাক্সক্ষা মনে পোষণ করেছিলেন। আর তখন থেকেই তাকে আঁকড়ে ধরে ইংরেজিপ্রীতি; পরের ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা। নিজের ভাষা বাংলাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার শৈল্পিক প্রকাশ তিনিই প্রথম প্রদর্শন করেছিলেন। আজো আমরা হয়তো অনেকেই মাতৃভাষাকে যথার্থ মর্যাদা দিই না; কিন্তু তা তেমনভাবে অর্থাৎ দালিলিকভাবে ব্যক্ত করার প্রবণতা খুব কম লোকেরই রয়েছে।

কিন্তু মধুসূদন সে কাজটি করেছেন নিঃসঙ্কোচে এবং তার জন্য নিজেকে নির্বোধও ভেবেছেন বিনা দ্বিধায়। এই বৈশিষ্ট্যটি তার সারল্য, মহত্ত¡ প্রকাশ করে। বঙ্গভাষা ও কপোতাক্ষ নদ কবিতা দুটিতে খুব স্পষ্টত কবির ব্যক্তিজীবনের প্রভাব পড়েছে। কবি মধুসূদন সাহিত্যসাধনার সূচনাই করেছিলেন ইংরেজি ভাষায়; পরে সে পথ পরিবর্তন করে বাংলা ভাষা মাধ্যমে শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করেন। একসময় তিনি অনুধাবন করেন, অন্যের ভাষায় সাহিত্য সাধনা করা কিংবা কল্পনারাজি বিকাশের পথ অন্বেষণ করা এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তিমাত্র। মাতৃভাষার মাহাত্ম্য অবহেলা করার অপরাধে নিজেকে অপরাধী মেনেছেন তিনি; অনুশোচনায় কাতরও হয়েছেন। তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় চিন্তার প্রকাশ ও বিকাশ দুরূহও বটে; এবং সে অভিপ্রায় অনভিপ্রেত, অশুভ এবং অগ্রহণযোগ্য। একে তিনি অভিহিত করেছেন অবরেণ্য বলে। বিভিন্ন ভাষায় দখল অর্জনকারী এই সাহিত্যিক এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন, মাতৃভাষার চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না।

আমাদেরও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন আইনে একটি ভাষা কমিশন গঠনের ব্যবস্থা থাকতে পারে। এ কমিশন সরকারের অধীন হবে না, রাষ্ট্রপতির অধীন হবে। সরকার এবং রাষ্ট্রের পঞ্চরঙ্গ : বিচার, শাসন, দেশরক্ষা, শিক্ষা, ব্যবসায়ের ভাষিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে এই কমিশন। রাষ্ট্রপতি প্রতি পাঁচ বছরের জন্য যোগ্য কোনো নাগরিককে ভাষাকমিশনের সভাপতি নির্বাচিত করবেন। দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে বাংলা ভাষা কমিশনের অফিস থাকবে। ভাষা কমিশনের মুখ্য দায়িত্ব হবে সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। পাঠ্যবই ও আইনের অনুবাদ করা, প্রতিশব্দ তৈরি করা থেকে শুরু করে বাংলা প্রচলনে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে বাংলা ভাষা কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা কমিশনের অগ্রগতির প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে এবং জনসমক্ষে পেশ করতে হবে। বাংলা প্রচলন আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকবে বাংলা প্রচলন দফতর। এ দফতর প্রতি বছর বাংলা প্রচলনের অগ্রগতি কিংবা বাংলা প্রচলন করতে গিয়ে উদ্ভূত কোনো সমস্যার ব্যাপারে কমিশনকে অবহিত করবে। পাঠযোগ্য এবং বোধগম্য বাংলায় ব্যবহারবিধি সরবরাহ না করে কোনো পণ্য বাজারে আনা যাবে না। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম বাংলার রাখা না হলে কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা না হলে কিংবা ইংরেজি অক্ষরের তুলনায় বাংলা অক্ষর যথেষ্ট বড় না হলে জরিমানার ব্যবস্থা থাকবে। আইন ব্যত্যয়কারী রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান জরিমানার আওতাভুক্ত হবে। ভাষা আইনে পরিষ্কার বলা থাকবে, কোন ধারা ভঙ্গ করার জন্য কী দণ্ড হবে। বাংলার সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মধ্যযুগে, সুলতানী আমলে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে। বাকি আছে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা যেটি নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করছে বাংলা ভাষার দীর্ঘজীবিতা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যত বেশি দীর্ঘসূত্রতা হবে, ততই পিছিয়ে যাবে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাভাষার প্রয়োগ এবং এর ফলে ব্যাহত হবে বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন।

স্বাধীনতা-পরবর্তীতে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে আইনও প্রণয়ন করা হয়। আইনের প্রয়োগ না থাকা অথবা মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞার কারণে দেশের বেশির ভাগ স্তরেই বাংলাবিমুখতা প্রকট আকার ধারণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হাইকোর্ট থেকে রুলসহ দুটি আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা একদিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই ভাষার সম্মান ও মর্যাদা অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন ভাষাবিদরা। আজকাল অনেকেই মনে করেন ইংরেজি জানা লোকেরা হয়তো বা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন। এটা কোনো প্রতিষ্ঠিত যুক্তিনির্ভর নয়।

কেননা যারা নিজ মাতৃভাষা বা বাংলা ভাষায় সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারে জানেন না তারা অন্য কোনো ভাষায় দক্ষতা বা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন এ কথা বলা যাবে না। প্রথমেই মাতৃভাষার শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে সে অন্য কোনো ভাষায় দক্ষ হতে পারেন। সুতরাং, বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ, সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং সঠিক বানান রীতির ওপর বাঙালি হিসেবে সব বাঙালিকে অপরিহার্যভাবে যত্নবান হতে হবে।

ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সারা বিশ্বে বাঙালির ঐতিহ্য তুলে ধরা। বাংলা ভাষার ঔৎকর্ষসাধনে ভাষা নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা, সাহিত্য চর্চা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘোষণা দিয়েছিলেন সর্বজনীন বাংলা ভাষার চর্চাকে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি জানতেন এই লড়াকু জাতির গর্ব করার বড় বিষয় হচ্ছে নিজস্ব ভাষা।

এই ভাষাই নিশ্চিত করেছিল স্বাধিকারের দাবিকে। তাই তো তিনি প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে আদালত পর্যায় সবজায়গাতেই বাংলাকে প্রাধান্য দেয়ার ওপর নির্দেশ দিয়েছিলেন। মাতৃভাষার উন্নয়নই হচ্ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পূর্ণতার অন্যতম নিয়ামক। এ লক্ষ্যে সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের জন্য বাংলা ভাষা কমিশন ও বাংলা প্রচলন দফতরের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রদান অপরিহার্য ও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। অধিকন্তু সভ্য ও জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ গঠনে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প হতে পারে না। যে জাতির মাতৃভাষা যত সমৃদ্ধ সে জাতির তত বেশি উন্নত। এ ছাড়া মাতৃভাষার সমৃদ্ধি ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি একে অন্যের পরিপূরক। তাই মাতৃভাষার বিকাশে সকল সামাজিক ও শিক্ষা কর্মসূচিতে মাতৃভাষার ব্যাপক ব্যবহার ও প্রচলনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com