বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রভাবশালী নেতা আবুল হারিছ চৌধুরীর জীবন-মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছেই না। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে তার ওপর ঝুলে আছে সাজা পরোয়ানা।
দেশত্যাগের পর গত ১৪ বছর তার কোনো খোঁজ নেই। সম্প্রতি হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী ফেসবুকে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ স্ট্যাটাস দেওয়ার পর ফের আলোচনায় আসেন হারিছ।
হারিছের পরিবার, স্বজন ও দলীয় নেতারা জানান- করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে মারা গেছেন তিনি। তাদের কেউ বলছেন- যুক্তরাজ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন, দাফন হয়েছে সেখানেই। কারও দাবি- ১/১১-এর পর বাংলাদেশই ছাড়েননি হারিছ চৌধুরী। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুর পর তাকে দাফন করা হয় ঢাকার একটি কবরস্থানে। যদিও তার মৃত্যু বা দাফনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত অকাট্য কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি কেউই।
হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত গতকাল বুধবারের তথ্য বলছে- ‘হারিছ চৌধুরী ১৯৪৭ সালে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দিঘিরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিকভাবে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।’
যদিও গত এক সপ্তাহ আজিমপুর কবরস্থানসহ জুরাইন ও বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে হারিছ চৌধুরীর লাশ দাফনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কবরস্থানগুলোয় গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত হারিছ চৌধুরী নামে কারও লাশ দাফন হয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে, এখনো ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে হারিছের নামে রেড নোটিশ ঝুলছে। বিভিন্ন অপরাধে পলাতক বাংলাদেশের রেড নোটিশধারী ৪৯ জনের মধ্যে হারিছের নাম ও ছবি আছে ১৩ নম্বরে। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। সব মিলিয়ে বিএনপির এই নেতা জীবিত না মৃত- এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
হারিছ চৌধুরী চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় মারা গেছেন, তাকে ঢাকার কাছে একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে- তার মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, এ খবরে হারিছের লাশ দাফনের স্থান শনাক্তে ঢাকার কবরস্থানগুলো চষে বেড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। খবরগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করতে গত ১৯ জানুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়। ২৫ জানুয়ারি এ বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব নেয় সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগ।
পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি মহিউল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, হারিছ চৌধুরী জীবিত না মৃত তা এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। যেহেতু তার নামে রেড অ্যালার্ট রয়েছে, তাই বিষয়টি নিশ্চিত হতে সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখনো প্রতিবেদন পাইনি। তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান খান বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ও যদি জানতে চান, তা হলে আর কী বলব!
হারিছ চৌধুরী জীবিত না মৃত- এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই চাউর হয়- হারিছ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ির (কানাইঘাটের দর্পনগর) পারিবারিক কবরস্থানে ৪টি নতুন কবর রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি কবরে সমাহিতদের পরিচয় জানা গেলেও কয়েক মাস আগে একটি কবরে গোপনে দাফন করা হয়েছে একজনকে। সেখানে কাকে সমাহিত করা হয়েছে জানেন না এলাকাবাসী। কারও কারও ধারণা- ওই কবরেই দাফন করা হয়েছে হারিছ চৌধুরীকে। তবে আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে সেই পারিবারিক কবরস্থানসহ পুরো এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে চাউর হওয়া সেই তথ্যের সত্যতা মেলেনি।
কবরস্থানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় দর্পনগর নয়াগ্রাম জামে মসজিদের ইমাম জামিল আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, এই কবরস্থানে গত কয়েক বছরে যাদের দাফন করা হয়েছে প্রত্যেকের জানাজা আমি পড়িয়েছি। এখানে হারিছ চৌধুরীকে দাফনের কথা থাকলেও কোনো কারণে তা আর হয়নি। চাউর হওয়া গায়েবি কবরের বিষয়টি শুনেছি আমিও। কিন্তু গত বছরের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত এই কবরস্থানে চারটি নয়, নতুন তিনটি কবর হয়েছে। এর একটিতে গত বছরের ৫ অক্টোবর কবরস্থ করা হয়েছে হারিছ চৌধুরীর ভাই এমরান হোসেন চৌধুরী ওরফে সেলিম চৌধুরীকে। অন্য কবরে দাফন করা হয়েছে হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই ফরিদ উদ্দীন চৌধুরীকে। অন্যটিতে কবরস্থ করা হয়েছে সাংবাদিক খাইরুল ইসলামের স্ত্রীকে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে হারিছ চৌধুরীসহ (যদি মারা যান) তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। জীবিতদের মধ্যে আব্দুল মুকিত চৌধুরী থাকেন ইরানে। আর সবার ছোট কামাল চৌধুরী থাকেন গ্রামের বাড়িতে।
গত রবিবার তিনি আমাদের সময়কে জানান, হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী জোসনা আরা চৌধুরী, ছেলে নায়েম শাফি চৌধুরী ও মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী যুক্তরাজ্যে থাকেন। বাবা গুরুতর অসুস্থ জানিয়ে কয়েক মাস আগে সামিরা ফোন করে কামাল চৌধুরীর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। এরপর থেকে ওই পরিবারের কারও সঙ্গে কামালের যোগাযোগ নেই। তাই হারিছ চৌধুরীর সর্বশেষ অবস্থার বিষয়ে নিশ্চিত নন তিনি। ফেসবুক ও গণমাধ্যমের কল্যাণে তিনি হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছেন। কিন্তু বড় ভাইয়ের পরিবার থেকে এ বিষয়ে কামালকে কিছু জানানো হয়নি। হারিছের লাশ বা তার কবরের বিষয়ে কেউ কোনো প্রমাণ দিতে না পারায় মৃত্যুর তথ্যে এখনো ধোঁয়াশায় আছেন তিনিও। হারিছ চৌধুরীর লাশ কোথায় জানতে চান কামাল চৌধুরী এবং তার স্ত্রী সাফিয়া বেগমও। হারিছ চৌধুরীর পরিবার যুক্তরাজ্যে থাকায় এ বিষয়ে জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশিক উদ্দিন চৌধুরীর ফেসবুক পোস্টের পরই তার চাচাতো ভাই হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর জানাজানি হয়। প্রথম থেকেই আশিক উদ্দিন চৌধুরী জোর দিয়ে বলে আসছিলেন- হারিছ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেখানকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হারিছ চৌধুরী। সে সময় যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছিলেন আশিক চৌধুরীও। এখন সুর পাল্টেছেন আশিক।
গত রবিবার তিনি আমাদের সময়কে বলেন, হারিছ ভাইয়ের লাশ বা কবর দিতে আমি দেখিনি। তাই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। যেহেতু ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানরা যুক্তরাজ্যে থাকেন, তাই আমি ভেবেছিলাম সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। নিশ্চিত করে তো কিছু বলিনি। তা ছাড়া একটা মানুষের মৃত্যু নিয়ে এত লেখালেখির কী আছে! উনি মারা গেছেন, এই তথ্যই কি যথেষ্ট নয়? লেখালেখি কইরা ওই পরিবারটারে আর ঝামেলায় ফেলায়েন না। এর পর ফোনের সংযোগ কেটে দেন তিনি।
গত রবিবার দাফনসংক্রান্ত রেজিস্টার খাতা দীর্ঘসময় ঘেঁটে আজিমপুর কবরস্থানের মোহরার হাফিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, গত বছরের জুন থেকে অদ্যাবধি আজিমপুর কবরস্থানে হারিছ চৌধুরী, বাবা আবুল শফিকুল হক চৌধুরী (মৃত) এই নামে কোনো মুর্দা দাফন করা হয়নি। হারিছ চৌধুরীর লাশ দাফন করা হয়েছে কিনা জানতে কয়েকদিন ধরে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আমার কাছে এসেছিলেন। তাদের কাছেও একই তথ্য দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, ভুয়া তথ্য দিয়ে এই কবরস্থানে কাউকে দাফন করার সুযোগ নেই। কারণ, দাফনের আগে মৃতের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), অথবা জন্মনিবন্ধন, কিংবা পাসপোর্টের ফটোকপি জমা নেওয়া হয় বাধ্যতামূলকভাবে। এগুলো কারও না থাকলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র অথবা চিকিৎসা সনদ জমা নিয়েও দাফনের ব্যবস্থা করা যায়।
গতকাল একটি সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের কোনো এক এলাকায় একটি মসজিদের অদূরেই দাফন করা হয়েছে হারিছ চৌধুরীর মরদেহ। করোনা আক্রান্ত অবস্থায় গাজীপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। অবস্থার অবনতি হলে শাহবাগের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। পরে গাজীপুরে নিয়ে লাশ দাফন করা হয়। তবে এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেনি সংশ্লিষ্ট কেউ।
Leave a Reply