বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক যে অবস্থান- এর প্রেক্ষাপট, ভাবদর্শন, নৈতিক ভিত্তি, আদর্শিক অবয়ব নির্মিত হয়েছিল উনিশ ও বিশ শতকে। ওই সময়ে যেসব চিন্তানায়ক, কর্মসাধক ও সমাজসংস্কারক তাদের মেধা এবং ব্যবস্থাপনা শক্তি, শারীরিক ও মানসিক শ্রম নিবেদন করে একটি মুক্তবুদ্ধি ও সৃজনশীল সমাজ জীবন-আদর্শ নির্মাণ করে গিয়েছেন- খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (২৬ ডিসেম্বর, ১৮৭৩- ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫) তাদের অন্যতম একজন।
শিক্ষা প্রশাসক ও চিন্তানায়ক, সমাজভাবনা সংগঠনের সব্যসাচী রূপকার, ইনসান আল কামিল, সুফিসাধক, সাহিত্য পথিক ও প্রকাশক এবং মানবসেবাধর্মী মিশন ও আদর্শের প্রবক্তা হিসেবে তিনি ছিলেন সমকালীন বাঙালি সমাজের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টায় নিবেদিত। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে তিনিই প্রথম সদস্য বা ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হন এবং অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর হওয়ার সুদুর্লভ গৌরব অর্জন করেন। অধঃপতিত ও অনগ্রসর স্বসম্প্রদায়ের নবজাগৃতি এবং তাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস প্রচেষ্টায় তার অনুপ্রেরণামূলক ও সমন্বয়ধর্মী সুকৃতি পথিকৃৎ এবং প্রযত্ন প্রদায়কের।
মানবতাবাদী এই শিক্ষা প্রশাসক সমাজের অভ্যন্তরে অবসাদ, অপচিন্তা ও অন্তর্ঘাতের সমস্যাবলির প্রতিও দিয়েছিলেন দৃষ্টি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে স্রষ্টার সব সৃষ্টির প্রতি সেবার আদর্শ জাগিয়ে তুলতে এবং একটি ইতিবাচক মনোভাব পোষণের দ্বারা মানবতাবাদী আদর্শ ও সেবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে সুপ্ত সমাজকে সচকিত করতে তিনি নিজে কলম ধরেছিলেন, অন্যের রচনা প্রকাশের সুযোগ অবারিত করতে প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন এবং ভক্তদের আত্মিক উৎকর্ষতা অর্জনে প্রেরণা, পরামর্শ প্রদানও পথপ্রদর্শনে ছিলেন আমৃত্যু আন্তরিক। তার সমাজভাবনার মহৎ কীর্তি ও ফসল আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা। এই মিশনের মাধ্যমে তিনি তার সমাজভাবনা এবং সর্বজীবের সেবাকর্ম ও ধর্মকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে সুন্দরবন সন্নিকটবর্তী অবহেলিত অজপাড়াগাঁয় নিদারুণ দারিদ্র্য পরিবেশে গড়ে তোলা তার ‘আহ্ছানিয়া মিশন’ কালের পরিক্রমায় এখন দেশ-বিদেশে সুপরিচিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
বিশ শতকের বাঙালি সমাজে, বিশেষ করে সমকালীন অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতির এক বিশিষ্ট পথপ্রদর্শক ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ। খানবাহাদুরের বিরানব্বই বছরের বর্ণিল জীবন, তেইশ বছরের শৈশব ও শিক্ষাকাল, চৌত্রিশ বছরব্যাপী অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগে সরকারি চাকরিকাল এবং চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর পঁয়ত্রিশ বছর সমাজসেবা ও অধ্যাত্ম সাধনা- এই তিন প্রধান পর্বে বিভক্ত।
কর্মবীর ও আধ্যাত্মসাধক আহ্ছানউল্লাহর জীবন ও সাধনার কালটি উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের নবচেতনা বিকাশেরও এক যুগসন্ধিক্ষণ। তিনি ছিলেন ওই সময়কার সমাজের একজন সচেতন, মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত ও আদর্শবাদী সদস্য। তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের ঘটনাপ্রবাহ থেকে নিজেকে নিসঙ্গ না রেখে বরং সচেতনভাবে সক্রিয় থেকে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ উদীয়মান তরুণ সমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা ও মূল্যবোধের নয়া চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করেছিলেন।
উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও পর্যায়ে। এটি আটপৈৗরে কোনো চাকরি জীবনযাপন ছিল না। তার পুরো কর্মজীবন ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশে বাংলা ভূখ-ের শিক্ষা পরিবেশ, পদ্ধতি, প্রক্রিয়ার সংস্কার ও উন্নয়নে উৎসর্গীকৃত। শিক্ষা-দীক্ষায় অত্যন্ত অনগ্রসর ও পশ্চাদপর সমাজ থেকেই তিনি উঠে এসেছিলেন এবং তারই স্কন্ধে ন্যস্ত হয়েছিল ওই সমাজের শিক্ষার উন্নয়ন সাধনের সুবর্ণ সুযোগ।
খানবাহাদুর আহছ্নাউল্লাহ একজন দক্ষ, দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ, আদর্শবাদী, মেধাবী, মননশীল ও মিশনধর্মী কর্মকর্তা ছিলেন অবিভক্ত বাংলা সরকারের শিক্ষা বিভাগের। তার কর্তব্যনিষ্ঠা ও কর্মধারায় বিমুগ্ধ কর্তৃপক্ষ তাকে ইন্সপেকশন লাইন থেকে প্রাদেশিক শিক্ষা সার্ভিসে আত্মীকরণ (তার আগে কেউ এ সুযোগ পাননি) করে সরকারি স্বনামধন্য বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার পদে নিয়োগ দিয়েছেন- যখন তার স্থায়ী চাকরির বয়স মাত্র সাত বছর। ১৯১১ সালে তিনি যখন ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন, তখন তার সরকারি চাকরির বয়স ১৫ ও নিজের বয়স ৩৮ বছর।
বস্তুত ১৯১৪ সালের হর্নেল কমিটির সদস্য হিসেবে ১৯১৭ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের কাছে লিখিত সাক্ষ্য ও স্মারকলিপি প্রদান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং সিন্ডিকেটে প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে বাংলা ও আসামের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে, বিশেষ করে সিনেটে ১৯১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুমোদন পর্যায়ে তিনি অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯১২ সালে সরকার কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ঘোষিত হওয়ার পর থেকে শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন ও স্বনামধন্য বাঙালি মুসলমান কর্মকর্তা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটে প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ প্রায় শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট হন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্লাইমেক্স পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া বিল ১৯১৯ বিবেচনার জন্য সিনেটে গঠিত বিশেষ কমিটিতে একমাত্র বাঙালি মুসলমান সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ। খসড়া বিল পরীক্ষা-পর্যালোচনা কমিটির সদস্য হিসেবে বিলের প্রতিটি অনুচ্ছেদেরে ধারা-উপধারার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে ও স্বার্থ সংরক্ষরণকল্পে তিনি পদে পদে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে কমিটির অন্য প্রভাবশালী সদস্যদের সঙ্গে বাদানুবাদে পূর্ববঙ্গের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা সংস্কৃতিতে চক্ষুষ্মান হওয়ার স্মারক এবং প্রাণবায়ু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্ন স্বার্থ ও আইনের আওতায় এই নবীন উচ্চ শিক্ষায়তনটির প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। সব মতের সঙ্গে স্বাভাাবিকভাবেই তিনি একমত হতে পারেননি।
এ কারণে ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি চার পৃষ্ঠার একটি নোট অব ডিসেন্ট দাখিল করে রিপোর্টে স্বাক্ষর করেছিলেন। তার নোট অব ডিসেন্টটি কমিটির রিপোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ওপর ১৯১৯ সালের ১৭ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিনেটে যে টানা তর্কবিতর্ক পর্যালোচনা হয়, সেখানে বারবার ফ্লোর নিয়ে প্রতিপক্ষের প্রস্তাব ও বক্তব্যের প্রতিবাদে তীব্র অথচ গঠনমূলক ভাষায় যুক্তি উপস্থাপন করে যে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন সিনেটের কার্যবিবরণীতে, তা রেকর্ড হয়। তিনি সমাজ অভ্যন্তরে জাতিগত সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা তথা ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাধীন ও স্বাভাবিক চর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তৎকালীন সরকারপ্রধানদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
তিনি বলেন-‘… রাষ্ট্রপতিদিগের সমীপে ইহাই বিনীত আবেদন যে, উভয় রাষ্ট্র মধ্যে আদান-প্রদানের বিধি-ব্যবস্থা অতি সত্বর সংঘটিত হয়, অধিবাসীগণের স্ব স্ব বাস-ভূমিতে শান্তির সহিত বসবস করিতে পারে, কেহ কাহারও ধর্ম বা আচার ব্যবহারে অভিযোগ বা হস্তক্ষেপ না করে, প্রত্যেকের ধর্ম্মাচারের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ও একটি বৃন্তে দুইটি ফুলের ন্যায় একই ¯্রষ্টার সৃষ্টি মনে করে ভ্রাতৃভাবে কাল-যাপন করে…।’
১৯১৮ সালে তিনি দাবি করেন, ‘বাঙ্গালা ভাষাকে জাতীয়ভাবে পূর্ণ করিতে হইবে ও তদনুসারে জাতীয় জীবন গঠন করিতে হইবে। আমাদের জাতীয় ইতিহাস, সামাজিক উপন্যাস, তাপসদিগের জীবনী সমস্তই আরবী, পারসী ও উর্দ্দু ভাষায় লিখিত; যে পর্য্যন্ত এইগুলি প্রকৃষ্ট বঙ্গভাষায় লিখিত না হইবে, যে পর্য্যন্ত বাঙ্গালা ভাষা মুসলমানের নিজস্ব বলিয়া পরিচয় না হইবে, সে পর্য্যন্ত বাঙ্গালা সাহিত্য জাতীয় শক্তি উদ্দীপিত করিতে সক্ষম হইবে না’।
কীভাবে বাংলা ভাষাকে তার উপযুক্ত মর্যাদার আসনে সমাসীন করা সম্ভবপর হবে, এ ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত ছিলেন। বাংলাভাষাকে অধিক পাঠে আগ্রহ সৃষ্টি ও সর্বত্র স্বাচ্ছন্দ্যে এটিকে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে, এই উপলদ্ধি এবং যৌক্তিকতায় বাংলা ভাষাতেই অধিকতর পাঠ্য রচনা, স্কুল-কলেজে পাঠ্যসূচিতে তার প্রাধান্য ও গুরুত্বারোপ, এর লেখন এবং পঠন রীতি-নীতির সংস্কার সাধনের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তার এ উপলদ্ধির কথাও জানান যে- সমাজের সমন্বিত উন্নতি, সমাজে সম্প্রদায়গত বিভেদনীতির অবসান কামনাকল্পে বিকশিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে সম্প্রদায়গত বিভেদের দেয়াল দূরীভূত করা সম্ভব।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ অসম্ভব উদ্যোগী, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও অতুলনীয় মনীষার অধিকারী ছিলেন। খানবাহাদুরের মন-প্রাণজুড়ে ছিল মানুষের সেবা করা, ধর্ম ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষকে প্রদীপ্ত করা। তার প্রধান উপলদ্ধি- ‘সৃষ্টিকে ভালো না বাসলে স্রষ্টাকে ভালোবাসা যায় না।’ কেবল নিজস্ব গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার উন্নয়নের জন্য নয়, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ অন্য অঞ্চল এবং অবকাঠামোর জন্য ও তার সাংগঠনিক কর্মদক্ষতাকে নিবেদন করেছিলেন।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
Leave a Reply