আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হল না। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা, দেশ-বিদেশের অগণিত অনুরাগীদের সব প্রার্থনা ব্যর্থ করে অমৃতলোকের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন কিংবদন্তি গায়িকা, সুরসাম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর।
সদ্যই করোনামুক্ত হয়েছিলেন। হারিয়েছিলেন নিউমোনিয়াকেও। তাও তাঁকে হার স্বীকার করতেই হল মৃত্যুর কাছে। ৯২ বছর বয়সে এই জোড়া ধাক্কা সামলে উঠতে পারলেন না। অন্য সুরলোকে চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। ৩০ জানুয়ারি শিল্পীর কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। কিন্তু বয়সজনিত নানা সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত আর লড়তে পারলেন না তিনি।
সরস্বতী পুজোর দিনেই এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তাঁর বিভিন্ন ধরনের থেরাপি চলছিল। অসুস্থ হওয়ার পরে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন লতা। সেখানেই আবার তাঁকে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দেওয়া হয়। রাখা হয় চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে। গতকাল রাতে খবর পাওয়া মাত্রই হাসপাতালে পৌঁছান আরও এক কিংবদন্তি গায়িকা তথা লতা মঙ্গেশকরের বোন আশা ভোঁসলে। হাসপাতালে ঢোকার মুখে আশা বলেন, `দিদির শারীরিক অবস্থার যাতে উন্নতি হয়, তার জন্য আপনারা প্রার্থনা করুন।` পাশাপাশি তিনি এও জানিয়েছেন যে, গায়িকার শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল। শুধু আশাই নন, গায়িকাকে দেখতে পৌঁছে যান উদ্ধব ঠাকরের স্ত্রী রেশমী ঠাকরেও।
শনিবার সকালে ৯২ বছরের গায়িকার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতেই তাঁকে ফের ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। যদিও চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন লতা। সুরসম্রাজ্ঞীকে দেখতে গিয়েছিলেন পরিচালক মধুর ভান্ডারকর, সুপ্রিয়া সুলেরাও। গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েলও। কিন্তু তারপরেই আজ সকালেই সব শেষ। স্তব্ধ হল কোকিলকণ্ঠ। চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতেই তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। সঙ্গে ছিল নিউমোনিয়াও। এর জেরেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন গায়িকা। ৯ জানুয়ারি থেকে ভর্তি মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে, আইসিইউ-তে। মাঝে শারীরিক অবস্থার সামান্য উন্নতির আভাসও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শনিবারই ফের তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়।
লতা মঙ্গেশকর ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন ইন্দোর রাজ্যের রাজধানী ইন্দোরের এক সঙ্গীত পরিবারে (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দীননাথ পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন মারাঠি সংগীত জগতের সুবিখ্যাত ধ্রুপদী গায়ক। বাবার থেকেই প্রথম সঙ্গীতের তালিম নেওয়া। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম একটি সিনেমার জন্য গান রেকর্ড করলেও, তা পরবর্তী সময়ে ছবি থেকে বাদ পড়ে। ১৯৪৫ সালে মুম্বইয়ে পাড়ি দেন। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সেখানে উস্তাদ আমান আলি খানের কাছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নেন। পরের বছর একটি হিন্দি ছবির জন্য প্লেব্যাকে গান করেন।
শৈশবে বাড়িতে কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না। বাবা চাইতেন ও শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক লতা। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হল, তখন বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাঁকে শুনতে হয় তা ছিল, কে এল সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি।
লতা যখন হিন্দি সিনেমায় গাইতে শুরু করেছেন। এমন একটা সময়ে বাঙালি প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর ছবি ‘শহিদ’ এ কাজের সুযোগ পেলেও সরু কণ্ঠের জন্য পছন্দ হয় না সংগীতকারের। ১৯৪৮ সালে ‘মজবুর’ সিনেমায় প্রথম বড় ব্রেক পান লতা। নেপথ্যে সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দার। পরবর্তী সময়ে লতা মঙ্গেশকর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, গুলাম হায়দার সত্যিই তাঁর গডফাদার। তিনিই তাঁর মেধার উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন।
১৯৫০ থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক ‘কোকিলকণ্ঠী’র গান মুগ্ধ করেছে দেশবাসীকে। দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে বিদেশেও অগণিত মানুষ তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠেন। আয়েগা আনেওয়ালা, প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া, আল্লা তেরো নাম, কঁহি দীপ জ্বলে – ছয় ও সাতের দশকে এসব গান জনপ্রিয়তার যে শিখর ছুঁয়েছিল, তা আজও অম্লান। বহু স্বনামধন্য সংগীত পরিচালকের সঙ্গেই কাজ করেছেন সুরসম্রাজ্ঞী। সেই তালিকাটা অনেকটাই বড়। শুধু কী তাই, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই নিজের তৈরি গান লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক এ আর রহমান নয়ের দশকে ‘দিল সে’ ছবিতে তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ান। ‘জিয়া জ্বলে’ গানটিতে আজও একক এবং অদ্বিতীয় লতা মঙ্গেশকর। বারবার তিনি নতুন করে মুগ্ধ করেছেন তাঁর সুরের জাদুতে মানুষকে।
জীবনভর মনপ্রাণ দিয়ে সুরসাধনার জন্য পুরস্কারও তিনি কম পাননি। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ছাড়াও ঝুলিতে এসেছে সিনে অ্যাওয়ার্ড অফ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট থেকে শুরু করে পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে, ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট, ভারত রত্ন-সহ একাধিক সম্মান। তিনি ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী কালে তিনি ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালে দুইবার ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন। অন্যদিকে, বিদেশের বহু সম্মান অর্জন করেছেন তিনি। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিও দনরের খেতাব পেয়েছেন।
কয়েক বছর ধরেই ধীরে ধীরে জনসমক্ষে ফিকে হচ্ছিল লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ। অসুস্থতার জন্য খুব বেশি কাজ করতে পারতেন না। নিজেকে ঘরবন্দি করে নিয়েছিলেন। তবে, উরিতে ভারতীয় জওয়ানদের সাফল্য কিংবা পরবর্তী সময়ে দেশে তোলপাড় ফেলে দেওয়া বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে ছোট করেই দিয়েছেন সুরেলা বার্তা।
বিশ্ব সংগীতের সব জাতি তাঁর কাছে ঋণী আজ, কালও থাকবে, যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে ততদিন। তাঁর ঋণ কোনও কালেই পরিশোধ করা সম্ভব নয়। যে সময়ে তিনি এসেছিলেন, সেই সময় থেকেই সমগ্র মানব সভ্যতা তাঁর ঋণ নত হয়ে স্বীকার করছে! লতা মঙ্গেশকর বাগদেবীর মানবী রূপ। আর দেবীর সৎকার হয় না!
প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে কিছুটা স্থিতিশীল হলেও চিকিৎসকরা তাঁকে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। পরে তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়েছিল জীবনদীপ নিভে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সুরসম্রাজ্ঞী হাসপাতালেই ছিলেন। দেশজুড়ে তাঁর দ্রুত আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা শুরু হয়। কিন্তু সব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। গত বছর জন্মদিনের আগেও সংবাদমাধ্যমকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আমার যে ৯২ হল মনেই হয় না’। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটা যুগের অবসান হল। কিন্তু ব্র্যান্ড রয়ে গেল। তিনি চলে গেলেও, বলে গেলেন- ‘লাগ যা গলে কে ফির ইয়ে হাসি রাত… হো না হো… শায়েদ ফির ইস জনম মে মুলাকাত হো না হো… ও ও…’
Leave a Reply