গত ডিসেম্বরের শেষে সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তৃতীয়বারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করছেন দেশের ১৩তম নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে, যারা বাংলাদেশের ১২তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনায় কমিশন গঠনের জন্য নাম গ্রহণ করা হয় কি না জানা নেই। তবে এ পর্যন্ত দু’টি সার্চ কমিটি করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতির আলোচনার পর সার্চ কমিটি গঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে তাদের কাজ কী, তা-ও পরিষ্কার নয়। পুরো প্রক্রিয়াটিই তেমন স্বচ্ছ নয়। যাই হোক, আমরা অপেক্ষায় রয়েছি এবারের পর্বে কমিশন কেমন হয় সেটা জানতে। কারণ আগের দুই কমিশন, যে পদ্ধতিতেই গঠিত হয়েছিল, তার অভিজ্ঞতা মোটেই সন্তোষজনক হয়নি। রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে কমিশন গঠন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই নির্বাচনের ফলাফল সবাই অবগত। ওই নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনীতি, সংসদ এবং নির্বাচনী সংস্কৃতিতে যোগ হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন। ওই সংসদে অর্ধেকের বেশি সদস্যক জনপ্রতিনিধি বলা যায় কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
যার ধারাবাহিকতা পরবর্তী ১১তম নির্বাচন কমিশনের সময় আরো ব্যাপকতা পায় যদিও ওইবারের সংসদের অনেক সদস্য রাতের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন বলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। এরপর প্রায় সব স্তরের স্থানীয় পর্যায়ের ভোটে, এমনকি উপনির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু প্রায় পাঁচ হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিলের যে ভোট ১২তম কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ছয় ধাপের পাঁচ ধাপ পর্যন্ত মোট এক হাজার ৫৫৫ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ নির্বাচন কমিশন এর কারণ খোঁজার ও প্রতিকারের চেষ্টাও করেনি। অনেক কারণের মধ্যে এ কারণেও ১২তম কমিশন ইতিহাসে উল্লিখিত থাকবে। মাঝে মধ্যে নির্বাচন কমিশন নিজেও অপারগতা স্বীকার করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন কি একাই নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য দায়বদ্ধ? অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পৃথিবীর যতগুলো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হয় সেগুলোতেও বেশির ভাগ দায়িত্বে তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা থাকে, তবে ওই সব সহযোগী সংগঠন যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে। আমরা সাধারণ জনগণ বিশ^াস রাখতে চাই যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশায় থেমে থাকবে না, বরং উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখাবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দারুণ গুরুত্বপূর্ণ, তাই আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
চলমান এই সংলাপে অনেক দল অংশ নেয়নি। রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে অনেক দল অংশ নেয়নি। বিএনপি সংলাপে আমন্ত্রণ পেয়ে সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি এবং বিএনপি বলেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন কখনোই স্বাধীনভাবে নিরপেক্ষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে অংশ নেয়া এবং সংলাপ বর্জন করা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইসি গঠন ও আগামী সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার পক্ষ ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মেরুকরণ দানা বাঁধবে। দেশে সৃষ্টি হবে সরকারবিরোধী নতুন মেরুকরণ ও আন্দোলনের নতুন মঞ্চ।
এর মধ্যেই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রপতির ইসি গঠনের কথাবার্তা শেষ হয়েছে। ইসি গঠনের আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদে পাস হয়েছে। এই আইনের বিল উঠছে সংসদে। দেখি কী হয়? জাতি তাকিয়ে আছে এই আইন কেমন হবে তার ওপর।
রাষ্ট্রপতি আয়োজিত বৈঠককে গণমাধ্যম সংলাপ বলে আখ্যায়িত করলেও এটিকে সংলাপ বলা যায় না। এমনকি রাষ্ট্রপতি নিজেও আমন্ত্রণপত্রে সংলাপের কথা বলেননি। বরং তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণের লক্ষ্যে তাদের সাথে আলোচনা করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। সংলাপ সাধারণত হয় মতবিনিময় ও ছাড় দেয়ার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছার লক্ষ্যে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই কোনো তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্য বা সমাধান প্রচার উদ্দেশ্যেই সংলাপের আয়োজন করা হয়। মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় পক্ষ প্রথমবারে একাধিকবার বিভিন্ন পক্ষের সাথে মতবিনিময় করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ধারাবাহিক সংলাপ হয়। সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে হয় এবং সমঝোতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত চলতে থাকে তবে সংলাপ সব সময় সফল হয় না।
রাষ্ট্রপতির এবারের সংলাপ আয়োজনের লক্ষ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত শুধু শোনা, ঐকমত্যে উপনীত হওয়া নয়। রাষ্ট্রপতির সামনে ফটোসেশন, চা-চক্র ও সাংবাদিকের সামনে বক্তব্য দেয়া নিঃসন্দেহে এ আয়োজনের আকর্ষণীয় দিক। রাষ্ট্রপতির মূল এজেন্ডা হতে পারত নির্বাচন নিয়োগ-সংক্রান্ত আইন তবে এ নিষ্ফল প্রক্রিয়ার বিষফল পরিণতি ঘটতে পারে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে নির্বাচন কমিশন গঠনে গত ৭৫ বছরেও কোনো আইন হয়নি। কিন্তু সেখানে কমিশন গঠনে দলীয় পক্ষপাতের অভিযোগ নেই। রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ওপর তাকে নির্ভর করতে হয় না। আমরা পাকিস্তানের দীর্ঘ সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিক নানা কর্মকাণ্ডের জন্য যত সমালোচনাই করি না কেন, তারা এমন একটি আইন করেছে, যা সত্যিকার অর্থেই অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং যার জন্য জাতীয় সমঝোতার বিকল্প নেই। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার আলোচনা ও সম্মতির ভিত্তিতে। প্রতিটি পদের জন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন এবং প্রস্তাবকৃত ব্যক্তিদের পার্লামেন্টের একটি কমিটির শুনানিতে হাজির হতে হয়। ওই কমিটি তাদের মধ্যে একজনের মনোনয়ন অনুমোদন করে এবং প্রেসিডেন্ট তাকেই নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা এসব পদের মনোনয়ন প্রশ্নে একমত হতে না পারলে তারা দু’জনেই আলাদাভাবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন। পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে তা পাঠান এবং কমিটি তাদের মধ্য থেকেই একজনকে বেছে নেয়। স্পিকার ওই পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে।
শ্রীলঙ্কায় নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের বাছাই করে ১০ সদস্যের সাংবিধানিক পরিষদ, যে পরিষদের সদস্য হলেন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রেসিডেন্টের মনোনীত একজন, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার যৌথ প্রস্তাবে মনোনীত ও প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত পাঁচজন এবং এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত এমন একজন, যিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার দলের সদস্য নন। আমাদের প্রতিবেশীদের এসব নজিরে যে বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষণীয়, তা হচ্ছে- ১. কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে সরকারের প্রভাবমুক্ত রাখার ব্যবস্থা; ২. প্রধান প্রতিপক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা এবং ৩. তা, অন্তর্ভুক্তিমূলক। কমনওয়েলথের সদস্যদেশগুলোর নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যে চর্চাগুলো সেরা, তার একটি সঙ্কলন ‘ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট : অ্যা কম্পেনডিয়াম অব কমনওয়েলথ গুড প্র্যাকটিসেস’-এর এসব বৈশিষ্ট্যের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এতে ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যায় সুযোগ গ্রহণের চাপকেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই সঙ্কলন তৈরির কাজটি করেছে কমনওয়েলথ।
বাংলাদেশের রাজনীতি কখনোই সরল পথে হাঁটেনি, উত্থান-পতনের এই ধারায়। যেমন রয়েছে অন্ধকার অধ্যায়, তেমনি আছে আন্দোলনের উজ্জ্বল পর্ব কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত হয়ে ওঠেনি এখনো। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। জাতীয় ইস্যুতেও মতানৈক্য প্রবল। এসব সমস্যার সমাধান না করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া দুরূহ হবে। রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তকরা এমনটাই মনে করেন।
যত মন তত মত। যত মত তত পথ-এই উক্তিটি রামকৃষ্ণ পরমহংসের। জানি না কোন পটভূমিতে, কী উদ্দেশ্যে তিনি এই উক্তি করেছিলেন। আমরা যদি পটভূমি ও উদ্দেশ্য সন্ধান না করে কেবল উক্তিটির অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করি, তাহলে কী পাই?
আমরা পাই যে, প্রত্যেক মানুষের একেকটি স্বতন্ত্র মন আছে। যেকোনো বিষয়ে প্রতিটি মনে একেকটি স্বতন্ত্র মত পাওয়া যায়। কোনো কাজ করতে হলে কিংবা কোনো সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রতিটি মতামত আলাদা উপায়ের কথা বলবে। যদি এর মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক কথা থেকে থাকে, তাহলে তা বিশ্বাসের ব্যাপার; যুক্তিবুদ্ধির কিংবা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বোঝার ব্যাপার নয়। আলাদা মত-পথ নিয়ে তো মানুষ টিকতে পারে না, অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। মানুষ সামাজিক জীব। খাওয়া-পরার জন্য, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাকে অন্যদের সাথে মিলে চিন্তা ও কাজ করতে হয়। তার জন্য পারস্পরিক ঐক্যের দরকার হয়। ঐক্যের অনেক সমস্যা- আছে; পারস্পরিক চেষ্টায় ঐক্যের সমস্যার সমাধান করতে হয়। এভাবেই চলছে প্রতিটি সমাজের, প্রতিটি জাতির ও গোটা পৃথিবীর মানুষ।
জাতীয় ইস্যুতে অনৈক্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অনেক কুফল বয়ে আনে। যারা দার্শনিক, চিন্তাবিদ, অর্থাৎ যারা প্রকৃতই রাজনীতিবিদ, তারা সবাই রাষ্ট্রগঠনের জন্য জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। আমাদের দেশে, মানে তখনকার ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধী এই জাতীয় ঐক্য খুব উপলব্ধি করেছেন।
লেখক : নব্বইয়ের সাবেক ছাত্রনেতা, সভাপতি-সাংবিধানিক অধিকার ফোরাম
Leave a Reply