বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির ঢেউ বাংলাদেশেও আঘাত হেনেছে। যেখানে ডিসেম্বরের শেষ দিনেও দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ছিল পাঁচ শর নিচে, সেখানে মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে এর সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে।
এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে ব্যবস্থা নিয়েছে। একই সঙ্গে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান নির্দেশনার পাশাপাশি বর্তমান সংক্রমণ বিস্তার রোধে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে।
বিজ্ঞাপন
১০০ জনের বেশি জনসমাগম নিষিদ্ধ। টিকা প্রাপ্তির সনদ বহন এবং সর্বস্তরে মাস্ক ব্যবহারের আবশ্যকতা সংবলিত নির্দেশনা জারি করেছে সরকার।
মহামারি বা অতিমারিতে সংক্রমণ যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, তখন এটি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড শুধু সমাজের কোনো বিশেষ অংশের অংশগ্রহণে সম্ভব নয়। সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণেই যেকোনো মহামারির বিরুদ্ধে বিজয় সম্ভব। দুই বছর ধরে করোনাযুদ্ধে মুখোমুখি বিশ্বের সব মানুষের পাশাপাশি বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ। নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে জীবন-জীবিকা পরিচালনার পাশাপাশি করোনা প্রতিরোধে আমাদের কিছু বিষয় সচেতনভাবে মেনে চলতে হবে। সঠিকভাবে মাস্ক পরা, জনসমাগম থেকে দূরে থাকা, ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভ্যাকসিন গ্রহণ এখন সবার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব। নিয়ম মেনে চললে দ্রুতই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া যাবে।
করোনাযুদ্ধে তৃতীয় বর্ষে পা রেখেছে বিশ্ব। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনার ওমিক্রন ধরন। যদিও বলা হচ্ছে, এ ধরনটির তীব্রতা, হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যুর হার তেমন একটা আশঙ্কার নয়। তার পরও তো এখনই বলা যাচ্ছে না যে কখন, কিভাবে থামবে এর গতি।
অতিমারির শেষটা কখন এবং কেমন হবে এ নিয়ে বিজ্ঞানী, গবেষক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন সংস্থা ও গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন অনুমান ও মতামত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা যেমন নিরাশার, তেমনি আশার আলোও দেখায়। সত্যিটা হচ্ছে, সব অতিমারিরই শেষ আছে; ইতিহাস তা-ই সাক্ষ্য দেয়। করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে ডেল্টা ধরনের মতো যেমন বিধ্বংসী ধরন যেমন ছিল, তেমনি ছিল নিছক সর্দি-কাশিরূপেও। এ রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা থেকে থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন—সব কিছুই এ অতিমারির বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমাদের শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থাও অনেকটা শিখে গেছে এ ভাইরাস প্রতিরোধ কৌশল। কারণ বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই হয় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে কিংবা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। সুতরাং ভাইরাসটি এর শেষ যাত্রার হিসাবটি যে দ্রুতই সাঙ্গ করবে তাতে সন্দেহ নেই।
করোনাজাতীয় ভাইরাসে সংঘটিত অতিমারির ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই যে প্রায় সব অতিমারির গড়ে দুই থেকে তিনটি ঢেউ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। সব ঢেউয়ের প্রথম দিকে মানুষের মৃত্যু হয়েছে বেশি। তবে আশার কথা হচ্ছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দ্রুততার সঙ্গে যেমন সফল ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে, অন্যান্য ফ্লুর ক্ষেত্রে কিন্ত তা সম্ভব হয়নি। স্প্যানিশ ফ্লুর কোনো ভ্যাকসিন ছিল না, এশিয়ান ফ্লু প্রতিরোধে শুধু সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে সীমিত সংখ্যক এবং হংকং ফ্লুর দুই কোটি ভ্যাকসিন যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত সম্পন্ন কমরছে, তত দিনে অতিমারির তীব্রতা কমতে শুরু করেছে। ভ্যাকসিনের চাহিদা কমে গেছে। তবে কভিড ভ্যাকসিন দ্রুত আবিষ্কার হলেও পৃথিবীর বহু দেশ এখনো ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পায়নি। তাই ভ্যাকসিন স্বল্পতা এবং স্বাস্থ্যবিধি পালনে অবহেলা ইত্যাদি কারণে করোনা অতিমারি আরো কিছুটা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন গবেষক, বিজ্ঞানী, অনুজীব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। নেচার ম্যাগাজিন বলেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে ঊহফবসরপ হিসেবে করোনার থেকে যাওয়ার আশাঙ্কা রয়েছে।
করোনার আগে যতগুলো ফ্লু জাতীয় অতিমারির আবির্ভাব হয়েছিল, প্রায় সব কটিই প্রাণঘাতী থেকে ক্রমান্বয়ে মৌসুমি ঠাণ্ডা-কাশিতে পরিণত হয়েছে। করোনার বেলায়ও একই পরিণতি ঘটবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। আবার প্রকৃতিও শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের এমন সব ধরন টিকিয়ে রাখে, যেগুলো আশ্রয়দাতাদের কম ক্ষতি করে। গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে ২০ শতাংশ ঠাণ্ডা, সর্দি ও কাশি চারটি বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাসের কারণে হয়। বর্তমান করোনাভাইরাস বা সার্স কভি-২ একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে ভাইরাস অনুজীব বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগের পর গত বছরের শেষ দিক থেকে দেশে দেশে করোনা রোগীর সংক্রমণ, তীব্রতা ও মৃত্যুর হার কমে আসতে শুরু করে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বিশ্ববাসীর জন্য আশার আলো। ১২ বছরের ওপরে বয়সী ছেলে-মেয়েদের দেহে সফলভাবে টিকা প্রদান শুরুর পর পাঁচ বছর এমনকি ছয় মাস বয়সী শিশুদের টিকার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। সফলভাবে এটি সম্পন্ন হলে দেশে দেশে দ্রুতই করোনা প্রতিরোধক হার্ড ইমিউনিটি লাভ করবে বিশ্ববাসী। তা ছাড়া করোনা চিকিৎসায় নানাবিধ নতুন নতুন আবিষ্কার ও অন্তর্ভুক্তি প্রতিরোধ মিছিলে নতুন জোয়ার আনবে বলে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় বিশ্বাস। ওমিক্রন এবং অদূর ভবিষ্যতে নতুন কোনো বিধ্বংসী ধরনের আবির্ভাবই শুধু বিশ্ববাসীকে সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার অন্তরায় হতে পারে।
করোনার অন্ধকার গুহার শেষ প্রান্তে আলোর রশ্মি যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি সাধারণ জীবনাচারে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে শঙ্কা যে নেই তা নয়। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস, আশানুরূপভাবে ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ব্যূহ গঠনে সময়সীমার কমতি, ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতি এবং করোনার নতুন নতুন ধরনের উদ্ভব এ আশার আলোকে স্তিমিত করে দিতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, করোনা পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নেবে তেমন সম্ভাবনা কম। এমন হতে পারে যে কিছু দেশ হার্ড ইমিউনিটি লাভে সক্ষম হবে। কিছু কিছু দেশে বিভিন্ন প্রদেশ বা অঞ্চলের মানুষ করোনা প্রতিরোধে হার্ড ইমিউনিটি লাভ করবে। ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং জনগণের ভ্যাকসিন গ্রহণে অনাগ্রহ কিছু কিছু দেশে হার্ড ইমিউনিটি লাভে সফলতার ঘাটতি দেখা দেবে। উপরন্তু নতুন ধরন উদ্ভবের বিষয়টি তো রয়েছেই। এহেন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশ দ্রুত সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে যেতে সক্ষম হবে। নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য কিছু দেশও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। বেশির ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হবে।
তবে জনস্বাস্থ্য বিষয়গুলোতে উন্নতি ও সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ প্রয়োগও মেনে চলা, বেশির ভাগ জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা এবং করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নতুন নতুন উদ্ভাবনা করোনা রোগীদের উপসর্গে তীব্রতা হ্রাস, হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যু হ্রাসে সহায়তা করছে এবং করবে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য এসব ব্যবস্থাপনাই করোনাযুদ্ধের সফল সমাপ্তি এনে দিতে পারে।
গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিশ্ববাসীকে আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০২২ সালই হতে পারে করোনাযুদ্ধের শেষ পর্যায়। যদিও তিনি ওমিক্রন এবং ডেল্টা সুনামির আশঙ্কার পুনরাবৃত্তি করে ভ্যাকসিন ও নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববাসীকে সমতা ও সংহতি শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। করোনা নামক শত্রুকে যুদ্ধের ময়দানে রেখে, প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অবহেলা করে করোনার দীর্ঘস্থায়ী করা এবং নতুনভাবে সংক্রমণে সহায়তা ও মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ারই নামান্তর। বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শীর্ষ সব সংস্থা ও গবেষকদের আশঙ্কা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং করোনা প্রতিরোধের সব ব্যবস্থা গ্রহণ ও এ বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে।
লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা
Leave a Reply