নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দৌড়ঝাঁপ। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে নির্বাচনী উত্তাপ। চলছে আলোচনা। বিশ্লেষণ। সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও আগ্রহ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও বিএনপির অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতা তৈমূর আলম খন্দকারকে ঘিরে। কার অবস্থান কেমন নাসিকের ভোটারসহ বিভিন্ন মহলে বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনা হচ্ছে। যদিও সরেজমিন মেয়র পদে দৃষ্টি কাড়ার মতো প্রচার, মিছিল-সমাবেশ চোখে পড়ছে না। ক্ষমতাসীন দলের ১৭ কেন্দ্রীয় নেতা, দলের সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন স্থানে জনসংযোগ, পথসভা ও মিছিলে অংশ নিচ্ছেন। তবে এতে হাতেগোনা কয়েকজন নেতাকর্মী ছাড়া স্থানীয় বেশিরভাগ নেতাকেই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচার, জনসংযোগ ও মিছিলে চোখেপড়ার মতো কর্মী-সমর্থকদের দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আইভী শিবির অগোছালো অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। যদিও আইভীর দৃঢ় বক্তব্য- নৌকার জয়ের জন্য কোনো প্রভাবশালী মহলের দরকার নেই। এমনকি আকারে-ইঙ্গিতে বলছেন, প্রভাবশালী সাংসদ শামীম ওসমানের কোনো সহায়তা নেওয়ারও তার আগ্রহ নেই। তার আস্থা সব সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জনগণের প্রতি। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে চলছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জের নানা জায়গা থেকে শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তৈমূরের অভিযোগ। এমন প্রেক্ষাপটে নাসিক নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চিত বিপদের শঙ্কা বিরাজ করছে তৈমূর শিবিরে। হতাশা ব্যক্ত করে তৈমূর বলেন, আমি ঘুঘুর ফাঁদ দেখতে শুরু করেছি।
রাজধানী ঢাকার একেবারে পাশের এলাকা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জ। সেখানে ৩ ও ৪নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে জনসংযোগের দায়িত্বে রয়েছেন দলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর। তিনি গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ৩নং ওয়ার্ডের মাদানীনগর মোড়ে পৌঁছান। সেখানে তাকে স্বাগত জানাতে অনেক নেতা গেলেও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। জনসংযোগকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবদুস সবুর বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখানে ব্যক্তিপর্যায়ে মান-অভিমান থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে নৌকার জয়ের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ।
প্রচারে না থাকা প্রসঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগ সত্য নয়। আমি দিনভর নৌকার পক্ষে কাজ করছি।
দলের নেতাকর্মীদের গা ছাড়া ভাব। আইভীর পক্ষে একাট্টা হয়ে কাজ করার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়নি। এমন দৃশ্য শুধু সিদ্ধিরগঞ্জে নয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বেশিরভাগ ওয়ার্ডেই।
এদিকে ভোট নিয়ে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। রয়েছে আতঙ্কও। প্রকৃত চিত্রটা কেউ প্রকাশ্যে বলতে চান না। বিভিন্ন চায়ের দোকানের আড্ডায় সেখানকার চিত্র অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের ভাষ্য- গত সিটি নির্বাচনে শামীম ওসমান অভিমান ভেঙে আইভীর পাশে ভাই হিসেবে বোনের জন্য শাড়ি উপহার নিয়ে গেলেও এবার ঘটেছে ভিন্ন চিত্র। গত সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে নৌকার পক্ষে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও আইভীর নাম উচ্চারণ তিনি করেননি। আইভীর প্রতি তার অভিমান ভেঙেছে এমন ইঙ্গিতও শামীম ওসমানের অনুসারীরা পায়নি। অনেকেই বলেছেন, তার কর্মী ও অনুসারীরা এখনো রয়েছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে।
চাষাঢ়া মোড়ে কথা হয় ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা সমীর ঘোষের সঙ্গে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন পরিস্থিতি গতবারের তুলনায় এবার ভিন্ন। গেলবার আইভী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন, এটি আগে থেকে বোঝা যাচ্ছিল। এবার দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের সংকট কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত আইভীর ভাগ্যে কী জুটবে তা বলা মুশকিল।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন বলেন, আইভী-তৈমূরের শোডাউন দেখে বোঝার উপায় নেই- কী ঘটতে যাচ্ছে নির্বাচনে। দুজনের নির্বাচনী প্রচার জনসমাবেশ প্রায় একই রকম। তবে সোমবার রাত থেকে তৈমূরের ঘাঁটিতে প্রশাসনের ধরপাকড় চলায় মঙ্গলবার তৈমূরের জনসংযোগে বিগত দিনের মতো লোক-সমাগম দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে আইভীকে ইঙ্গিত করে তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, এ নির্বাচনে যদি আপনি পুলিশ দিয়ে এভাবে হয়রানি করেন, তা হলে আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমি মনে করি। আপনার নিজের ভাবমূর্তির প্রশ্নে বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন।
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমূরের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে পুলিশের হয়রানির অভিযোগে আইভী বলেন, আমি প্রচারে ব্যস্ত, তাই সঠিক জানি না। তবে আমরাই তো বলি- সব ধরনের অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করা হোক। শহরের মধ্যে যারা মাদক ব্যবসায়ী, যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, তাদের গ্রেপ্তার করা হোক- এটি সব প্রার্থীরই চাওয়া থাকে।
তৈমূর আলমের অভিযোগ, তার কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ হানা দিচ্ছে। ভয় দেখাতে অনেককেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। জেলার এসপি আশ^স্ত করেছেন হয়রানি করা হবে না। কিন্তু আমরা হয়রানি হচ্ছি। কারও বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট থাকলে আগে গ্রেপ্তার না করে এখন কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে- এমন প্রশ্ন করেন তিনি। তৈমূর আলম খন্দকারের অভিযোগ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের এসপি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান অব্যাহত থাকবে। অভিযান আরও তীব্র হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে নাশকতার মামলায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরা সব ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিচ্ছি।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও গতকাল বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আটক ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। অহেতুক বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয়নি। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। বিএনপি মাঠ ঘোলা করতে অভিযোগ তুলে মিথ্যাচার করছে।
Leave a Reply