প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই পুরোদমে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের দুই হেভিওয়েট প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকার প্রচার কার্যকম শুরু করেছেন। একইসঙ্গে প্রচার শুরু করেছেন অন্যান্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
নির্বাচনের তফসিল অনুয়ায়ী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ, দাখিল, যাচাই-বাছাই এবং প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়েছে আগেই। গতকাল ছিল প্রতীক বরাদ্দ কার্যক্রম। অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে এই পর্ব শেষ করেছেন নির্বাচনী কর্মকর্তা। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আইভী যথারীতি পেয়েছেন দলীয় প্রতীক নৌকা। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার তার চাহিদা অনুযায়ী হাতি প্রতীকই পেয়েছেন। বেলা সাড়ে ১১টায় নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে এসে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রতীক বরাদ্দ নেন তৈমূর আলম। দুপুর ১২টায় সদ্য বিদায়ী মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী তার নৌকা প্রতীক বরাদ্দ নেন।
এর আগে সকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতীক বরাদ্দের কার্যক্রম শুরু করেন রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা। মেয়র পদে অপর ৫ প্রার্থীও প্রতীক বরাদ্দ পেয়েছেন। তারা হলেন- ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মাসুম বিল্লাহ (হাতপাখা), খেলাফত মজলিশের এ বি এম সিরাজুল মামুন (দেয়ালঘড়ি), কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম বাবু (ঘোড়া)। প্রতীক বরাদ্দের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকার।
আগামী ১৬ জানুয়ারি তৃতীয় বারের মতো হতে যাচ্ছে নাসিক নির্বাচন। এর আগে ২০১১ ও ২০১৬ সালে নির্বাচন হয়েছিল। অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এর আগে আমি একটি দল থেকে নির্বাচন করছিলাম। তাই আমাকে বসে যেতে হয়েছে। এবার আমি জনগণের প্রার্থী। গতকাল সকালে প্রতীক বরাদ্দের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
তৈমূর বলেন, অনেকে প্রশ্ন করেন কেন আমি দাঁড়িয়েছি। আমি জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি করলেও নারায়ণগঞ্জের জনগণের চাহিদা ও তাদের আকাক্সক্ষার ব্যাপারে আমাকে সচেতন থাকতে হয়। জনগণের প্রয়োজনেই আমাকে এখানে নির্বাচনে দাঁড়াতে হয়েছে। তিনি বলেন, নৌকায় কিন্তু হাতি উঠলে ডুবে যায়। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স সবচেয়ে বেশি। এখানে নাগরিক সুবিধা কম। নারায়াণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ২২ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স নেয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রাম নেয় ১৪ শতাংশ। আমি জনগণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন করছি। জনগণ আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
তৈমূর আলম আরও বলেন, আমাকে শামীম ওসমান, পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নারায়ণগঞ্জ শহরে হাঁটতে হয়েছে। আমি মানুষের ভালোবাসায় প্রার্থী হয়েছি। শামীম ওসমানের পায়ে আমি হাটি না নারায়ণগঞ্জ শহরে। আমি আস্থা রাখতে চাই, কিন্তু আস্থা রাখতে পারছি না, গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতারা প্রতীক, প্রার্থীসহ সমাবেশ করেছে। আমরা ১৬ ডিসেম্বর ২০ হাজার লোকের সমাবেশ ঘটিয়েছি নারায়ণগঞ্জ শহরে, ইসির অনুরোধে আমি সেখানে যাইনি। আমি আইন মেনে চলেছি, কিন্তু সরকার দলের প্রার্থী আইন মানছেন না।
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হলো। এজন্য অবশ্যই আমি অনেক আনন্দিত। ইনশাআল্লাহ আমরা বরাবরের মতো নৌকা নিয়ে জয়যুক্ত হব। ২০১৬ সালেও আমার প্রথম প্রতীক ছিল নৌকা। নারায়ণগঞ্জবাসীও আমাকে ভোট দিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ আমি সেবার নির্বাচিত হয়েছিলাম। এবারও আমি মনে করি আমার শহরবাসী আমার প্রতীক নৌকাকে বিজয়ী করবে। এ সময় টেক্স দ্বিগুণ করা নিয়ে বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলমের করা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইভী বলেন, একদমই মিথ্যা কথা। এটা সুপরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে। আমি একটু পরিষ্কার করতে চাই, আগে ওয়াসা আমাদের সঙ্গে ছিল না। ওয়াসার যে তিন পার্সেন্ট ট্যাক্স এটা আগে তারা নিতো। এখন যেহেতু ওয়াসাটা সিটি করপোরেশনের আন্ডারে তাই এই ট্যাক্স সিটি করপোরেশন নিচ্ছে। ওয়াসার টেক্সটাই এখন সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটা বিগত কয়েক বছর ধরেই নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এতদিন কোনো কথা হয় নাই। এখন একজন প্রার্থী সুকৌশলে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে কিনা জানতে চাইলে আইভী বলেন, ইনশাল্লাহ সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে। কারণ নৌকার বাইরে আওয়ামী লীগের কারও যাওয়ার সুযোগ নেই এবং তারা যাবেও না। সাধারণ ভোটারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি বিগত ১৮ বছর (২০০৩ পৌসভাসহ) কাজ করেছি। সিটি করপোরেশনে ১০ বছর। আমি কোনদিন দলমত, ধর্ম, বর্ণ দেখি নাই। কখনো আমি এই বিষয়ে যাচাই করি নাই। আমি চেষ্টা করেছি সাধারণ মানুষদের সেবা করার জন্য। আমার বিশ^াস তারা আমাকে ভোট দিবে। সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দল যখন দলীয় প্রতীক কারও হাতে দেয় তখন সেটা যাচাই বাছাই করেই দেয়। এখানে আলাদা করার কিছু নাই। এখানে দল ব্যক্তি সবই একাকার। আমি যদি আজকে আওয়ামী লীগ না করতাম বা দলের কেউ না হতাম, তা হলে নৌকা মার্কাটা আমাকে দেওয়া হতো না।
নারায়ণগঞ্জ সিটির মানুষ সেবা পায় নাই- তৈমূর আলমের করা বিভিন্ন সময়ের এই মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, এই শহরের যারা নাগরিক আছেন, তারা সবাই দেখেছেন, আপনারা সেবা পেয়েছেন নাকি পান নাই। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্বাচন করতে এসেছেন। এখন উনি অনেক কথাই বলবেন। তিনি তার বাসা থেকে বের হয়ে যে রাস্তাটিতে পা রাখছেন, সেটা কিন্তু সিটি করপোরেশনের করা এবং নির্বাচনের প্রচারের জন্য যে ২৭টি ওয়ার্ডে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, প্রতিটি রাস্তা, ড্রেন এমনকি খেলার মাঠ, পার্ক সবই কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের করা।
নৌকার পক্ষে যুবলীগের বর্ধিত সভা : নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুবলীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল দুপুরে চাষাঢ়ায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মঈনুল হোসেন খান নিখিল। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল কাদির, সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, সহসভাপতি আহাম্মদ আলী রেজা রিপন, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া সাজনু, সাধারণ সম্পাদক আহাম্মদ আলী রেজা উজ্জলসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সভায় মঈনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, বিজয়ের মাসে বিজয়ের প্রতীক। যে প্রতীক আমাদের আদর্শের প্রতীক, আমাদের হৃদয়ের প্রতীক। এখানে আপনারা অনেকে অনেক কথা বলেন। আমি কোন কথা বিশ^াস করতে চাই না। এ সময় তিনি উপস্থিত নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বলেন, আগামী ১৬ জানুয়ারি নির্বাচনে নৌকাকে জয়ী করতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, যারা শেখ হাসিনার কর্মী আমাদের আদর্শের প্রতীক নৌকা। সততার প্রতীক নৌকা, উন্নয়নের প্রতীক নৌকা। সেই নৌকাকে জয়ী করতেই হবে। নৌকা প্রতীক ছাড়া অন্য প্রতীকে ভোট দিলে আদর্শ বিচ্যুত হবে।
তৈমূর ও আইভীকে ইসির শোকজ : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে পাল্টা-পাল্টি লিখিত অভিযোগ দেন। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে উভয় প্রার্থীকেই শোকজ করেছে ইসি। গত সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) দুটি আলাদা চিঠিতে এই শোকজ করেন নাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার। এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে এবং ২৭ ডিসেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের বিরুদ্ধে পাল্টা-পাল্টি নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ দেওয়া হয়। নোটিশে উভয়কেই আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তারের কাছে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগের বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রতীক বরাদ্দের পর কাউন্সিলর প্রার্থীদের আনন্দ মিছিল : নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়েছে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে। গতকাল আনুষ্ঠানিক প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরা আনন্দ মিছিল করেন। দুপুরের পর থেকেই সিটি করপোরেশনের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডের প্রার্থীরাই মিছিল ও প্রচার করেছেন। অনেকে আগে থেকেই কাক্সিক্ষত প্রতীক দিয়ে ডিজিটাল পোস্টার করে রেখেছিলেন। প্রতীক পাওয়ার পর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন।
Leave a Reply