করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘ ৫৪৫ দিন ধরে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ খুলছে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর। গতকাল শুক্রবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এ সময় তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দেন। স্কুল খোলার বহুল প্রত্যাশিত এ ঘোষণায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা খুশি, তবে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। এরপর ব্যাপক শঙ্কা-উদ্বেগের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্লাস হয় ১৬ মার্চ পর্যন্ত। ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। দফায় দফায় বাড়িয়ে সেই ছুটি চলবে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকায় সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জোর দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। এর মধ্যেই শিক্ষামন্ত্রী নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করলেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) স্কুল খোলাবিষয়ক গাইডলাইন অনুযায়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হলে সেখানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হবে। ক্লাসে বেঞ্চে তিন ফুট দূরত্বে বসবে শিক্ষার্থীরা। এমনকি স্কুল প্রাঙ্গণে চলাফেরাতেও তিন ফুট দূরত্ব মানতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন তদারকিতে কমিটি থাকবে, এ কমিটি নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনিটরিং করবে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গতকাল চাঁদপুর সদর উপজেলার মহামায়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারব। স্কুল-কলেজগুলো খোলার জন্য আমরা আগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ১২ সেপ্টেম্বরকে আমরা নির্ধারণ করেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে আমাদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং থাকবে। যাতে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত না হয়।
বিশ^বিদ্যালয় খোলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবে। এরপরও আমরা উপাচার্যদের সঙ্গে কথা বলব। তারা যদি অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খুলতে চান, খুলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা গ্রহণের কার্যক্রমসহ খোলার প্রস্তুতি আগে সম্পন্ন হবে, সে বিশ্ববিদ্যালয় আগে খুলে দেবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগের ঘোষণা অনুযায়ী পরীক্ষা হবে। অর্থাৎ, নভেম্বরের মাঝামাঝি এসএসসি এবং ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও শুরুতে একসঙ্গে সব শ্রেণির ক্লাস হবে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ধাপে ধাপে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস হবে। প্রথমে হয়তো এ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং আগামী বছরের পরীক্ষার্থীরা প্রতিদিনই ক্লাস করবে। বাকি শ্রেণির ক্লাস হয়তো শুরুতে একদিন করে হবে। পরে অবস্থা বুঝে ধীরে ধীরে তা বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে অনলাইন ও টেলিভিশনের ক্লাসও চলবে। অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়াও চলমান থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষক করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়েছেন। ভবিষ্যতে ১২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা সরকার করছে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গত সপ্তাহে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লা গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা মনে করছি দীর্ঘ ১৭ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, এটা করোনা ভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় ভালো কাজ করেছে। এখন আমার মনে হয় সব দিক বিবেচনা করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া যেতে পারে।
এর আগে ১৮ আগস্ট সচিবসভায় করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং টিকা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকালও তিনি জাতীয় সংসদে খুব তাড়াতাড়ি স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। গতকাল তিনি মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আমাদের আগেই নির্দেশনা দেওয়া ছিল। প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের ঢিলেমির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যাবে।
স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের জন্য মাউশির স্কুল খোলার গাইডলাইনে বলা হয়েছে, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব দৃশ্যমান স্থানে ‘নো মাস্ক, নো স্কুল’ লিখে তা সবাইকে মানার নির্দেশ দিতে হবে। স্কুলে প্রবেশের আগেই সবার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি ৩০ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য একটি এবং ৬০ জন ছেলে শিক্ষার্থীর জন্য একটি- এই অনুপাতে টয়লেট সংখ্যা বিবেচনা করতে হবে। দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্লাসের পড়ালেখা সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্ত করার জন্য নিরাপদ ও আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মাউশির পক্ষ থেকে। বলা হয়েছে, প্রথম এক বা দুই সপ্তাহ পাঠক্রমভিত্তিক শিখনের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
আরও বলা হয়েছে, স্কুল খোলার পর সব ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বেঞ্চে বসার সময় দুই শিক্ষার্থীর মাঝে দূরত্ব থাকবে তিন ফুট। বেঞ্চের দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুটের কম হলে প্রতিটিতে একজন করে শিক্ষার্থী বসতে পারবে। দৈর্ঘ্য পাঁচ থেকে সাত ফুট হলে প্রতি বেঞ্চে দুজন করে বসতে পারবে। স্কুলের প্রাঙ্গণ ও খোলা জায়গায় চলাফেরা করতে হবে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে।
মাউশির নির্দেশনায় আরও বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রথম ১৫ দিন যে কোনো একটি শ্রেণির কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে। ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত সব শ্রেণির কার্যক্রম একই সঙ্গে চালু করতে হলে কয়টি শিফট প্রয়োজন হতে পারে এবং প্রতিটি শিফটের জন্য শিক্ষাঘণ্টা কতটুকু হবে, তাও নির্ধারণের পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনে দূরশিখন ও সপ্তাহ বিভাজন করে একেক দলকে একেক সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল খোলার গাইডলাইনে আরও বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর প্রথম দুই মাসের মধ্যে এমন কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা বা মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা যাবে না, যা শিক্ষার্থীর ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলশিক্ষার্থীর অভিভাবক ফোরামের সভাপতি আমিনা রত্না আমাদের সময়কে বলেন, স্কুল খোলার সিদ্ধান্তে ভালো লাগছে। তবে স্কুলের শিশুরা স্বাস্থ্যবিধি মানতে কতটা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে এটা নিয়ে শঙ্কিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ অনেক দিন। খুলে দেওয়া দরকার। তবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাও দরকার। অক্টোবরে শীত আসছে। এখন এই ভাইরাসের ভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট, শীতে এর প্রকোপ বাড়ে কিনা, সে ক্ষেত্রে কী হবে?
শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্কুল খুলে শুরুতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস নেওয়া হবে। নবম ও একাদশ শ্রেণির ক্লাস হবে সপ্তাহে দুদিন। অন্যান্য শ্রেণিতে সপ্তাহে একদিন ক্লাস নেওয়া হবে। পরিস্থিতি ভালো হলে স্কুল খোলার দুই-তিন সপ্তাহ পর থেকে সব শ্রেণিতে স্বাভাবিক ক্লাস নেওয়া হতে পারে। প্রাথমিকেও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বেশিদিন স্কুলে আনা হবে। অন্যান্য শ্রেণিতে এক-দুইদিন ক্লাস হতে পারে। আর প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাসও অবস্থা বিবেচনা করে শুরু করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে স্নাতক শেষবর্ষ ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য পাঠিয়ে সহায়তা করেছেন চাঁদপুর ও মানিকগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি।
Leave a Reply