বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।
অদম্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে দেশ। এই উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দরিদ্রতা। জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের সময় বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ।
একটানা ৩ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে গত সাড়ে ১২ বছরে তিনি এ হার ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হতে হলে দারিদ্র্যের হার আরও কমাতে হবে। দেশের অসহায়-দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করতে হবে।
‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীন-গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের আওতায় আনছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন- ‘বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের ৬৪ জেলার ভূমিহীন ও গৃহহীনদের তালিকা করা হয়। এ তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির তত্ত্বাবধানে একটি চলমান প্রক্রিয়া।
তালিকা অনুযায়ী ‘ক শ্রেণি’ অর্থাৎ একেবারেই ভূমিহীন ও গৃহহীন ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১ পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এ ছাড়া যার জমি আছে কিন্তু ঘর নেই অথবা জরাজীর্ণ ও ভঙ্গুর ঘর রয়েছে এমন ‘খ শ্রেণি’ভুক্ত ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত সব পরিবার পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসিত হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী, বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শন করেন এবং নদীভাঙনকবলিত ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় পরিবারগুলোকে গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসিত করেন। কক্সবাজার ও অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯৯৭ সালের ১৯ মে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ মে টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন পরিদর্শন করে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীন গরিব পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী সে বছরই দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প চালু করেন।
আশ্রয়ণ মানে কেবল আবাসনের ব্যবস্থা নয়; বরং এর পরিধি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। উপকারভোগীরা দুই শতাংশ করে জমি পেয়েছেন; একটি অর্ধপাকা দুই কক্ষের ঘর পাচ্ছেন; বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগছে এখানে এবং এতে রয়েছে গোসলখানা, টয়লেট ও রান্নাঘর।
গৃহসহ জমি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে যৌথভাবে দলিল করে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো হচ্ছে। প্রতি দশটি পরিবারের সুপেয় পানির জন্য থাকছে একটি করে নলকূপ। ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবেন সুবিধাভোগীরা। তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্মিত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আশ্রয়ণের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের শরীর গঠন ও বিনোদনের জন্য প্রকল্প এলাকায় রয়েছে খেলার মাঠ। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গ্রামের সব নাগরিক সুবিধাই থাকছে আশ্রয়ণ প্রকল্পে।
উপকারভোগীদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পেশামুখী দশ দিনের প্রশিক্ষণ। বিশেষ করে ব্যারাকে বসবাসকারী সুবিধাভোগীদের মৎস্য চাষ, পাটি বুনন, নার্সারি, নকশিকাঁথা, ওয়েল্ডিং, ইলেকট্রিক ওয়ারিং এবং রিকশা-সাইকেল-ভ্যান গাড়ি মেরামতের মতো ৩২টি পেশায় প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। এ প্রশিক্ষণ চলাকালে তাদের আয়-রোজগারের যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য প্রতিদিন ৭৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ-পরবর্তী সময়ে উপকারভোগীরা সমবায় সমিতি গঠন করে আয়বর্ধনকারী ব্যবসা বা পেশা চালুর জন্য ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পাচ্ছেন। ব্যারাকে পুনর্বাসিত পরিবারপ্রতি প্রাথমিকভাবে তিন মাসের ভিজিএফের আওতায় খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন, বয়স্ক, বিধবা বা অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতাপ্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন তারা। অর্থাৎ একজন নিঃস্ব ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানবসম্পদে পরিণত করে আত্মপ্রত্যয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দরিদ্রতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘খাদ্য ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধাদির ওপর জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ বা অধিকার প্রতিষ্ঠাতে অসামর্থ্য হওয়ার কারণেই অর্থাৎ ফেইলিওর অব এন্টাইটেলমেন্ট বা স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার কারণে সমাজে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যদশা দেখা দেয়।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হতদরিদ্র ভিক্ষুক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল মানুষকে ভূমি ব্যবহারের আওতায় এনে অন্যান্য সামাজিক সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জলবায়ু উদ্বাস্তু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে, দলিত, হরিজনসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়কেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ কর্মসূচিতে। বিশ্বে এটি প্রথম ও সর্ববৃহৎ উদ্যোগ, যাতে রাষ্ট্রের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে তুলে আনার জন্য সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে বাসস্থান নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সব নাগরিকের জন্য মৌলিক উপকরণপ্রাপ্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের ৩.১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস এবং সবার জন্য বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে। পরিবেশ ও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার পূর্ণতা পেয়েছে। আশ্রয়ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) এর ১নং দারিদ্র্যের অবসান, ২নং ক্ষুধা নির্মূল, ৩নং স্বাস্থ্যসেবা, ৪নং মানসম্মত শিক্ষা, ৫নং লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, ৬নং সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন, ৮নং উপযুক্ত কর্মসংস্থান, ১০নং অসমতা কমিয়ে আনা এবং ১১নং টেকসই ও নিরাপদ জনবসতির মতো অনেক লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য আসছে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধারণার প্রচলন ছিল। বৈদেশিক সাহায্য, খাদ্য সহায়তা, ত্রাণ প্রদান এবং ক্ষুদ্র ঋণের নামে শোষণ ও বঞ্চনার কারণে একজন দরিদ্র ব্যক্তি চরম দারিদ্র্যদশার মধ্যে পতিত হতো। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ড্যানি রড্রিক পূর্ব এশিয়ার উচ্চ প্রবৃদ্ধির ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমির মালিকানা পুনর্বণ্টন গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসাবে কাজ করে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে উপকারভোগীরা ঘরসহ ভূমির মালিকানা পাওয়ার পাশাপাশি আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাদের মেধা ও শ্রম দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও পরিবার হীনম্মন্যতা কাটিয়ে একটি সম্মানজনক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখছে। এভাবেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শামিল করছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
আশ্রয়ণ প্রকল্প বাংলাদেশের দরিদ্রতা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের এই নতুন পদ্ধতি ইতোমধ্যে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। ‘শেখ হাসিনা মডেলে’র মূল ছয়টি বৈশিষ্ট্য নিুরূপ-
১. উপার্জন ক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা; ২. সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; ৩. নারীদের ঘরের অর্ধেক মালিকানা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন; ৪. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন; ৫. ব্যাপক হারে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের উন্নতি সাধন এবং ৬. গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল দর্শনই ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা সে লক্ষ্য পূরণে দিন-রাত কাজ করে চলেছেন। ‘বাদ যাবে না একটি মানুষও’- এ মূলনীতিকে সামনে রেখেই তিনি সব উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্নক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ‘সোনার বাংলাদেশ’-এর দিকে ক্রমেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আশা করা যায়- উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে।
এমএম ইমরুল কায়েস: প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব-১
Leave a Reply