সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির পদ দখলের অপচেষ্টার প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দীর্ঘ দিন থেকে মিছিল সমাবেশ, প্রতীকী অনশন, কালো পতাকা মিছিল করেছে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। তাদের দাবি অনির্বাচিত কেউ কখনো সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি পদে বসেননি।
নির্বাচন ছাড়া কোনো অবৈধ প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি আইনজীবীরা মেনে নেবে না। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা পাল্টা স্লোগান দিয়েছে। এক পর্যায়ে সভাপতি পদ নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে একই স্থানে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে পাল্টাপাল্টি মিছিল-স্লোগান দিয়েছে। সভাপতির পদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে বর্তমান এমন পরিস্থিতি অতীতে কখনো সৃষ্টি হয়নি বলে মনে করছেন সাধারণ আইনজীবীরা। তারা বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করার দাবি জানান। তবে সিনিয়র আইনজীবীরা সাধারণ সভায় সিদ্ধান্তের আলোকে নির্বাচিনের মাধমে এ সমস্যার সমাধান চান।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের সংবিধানে আছে এই সভাপতির পদ খালি হলে সে ক্ষেত্রে এক মাসের মধ্যে মিটিং দিয়ে সিদ্ধান্ত হবে কিভাবে কোন পদ্ধতিতে সভাপতি নির্বাচন করা যায়। সেই সভা ডেকে ছিলেন সম্পাদক। সেটি সিনিয়র সহসভাপতির সভাপতিত্বে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি গ্রুপ হাত জাগিয়ে ঘোষণা দেয় অমুক সভাপতি। আমরা কখনো দেখিনি হাত জাগিয়ে কখনো সভাপতি নির্বাচিত হয়। এটিও দেখিনি অ্যাটর্নি জেনারেল কখনো সভাপতি নির্বাচন করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল তো পদাধিকার বলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তিনি কিভাবে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি হন। এটি আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী। যারা হাত জাগিয়ে সভাপতি করেছেন তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আর যাকে বসতে বলা হল, তারই বলা উচিত ছিল অ্যাটর্নি জেনারেল বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আমি বারের সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারি না।
জয়নুল আবেদীন বলেন, নির্বাচন ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি হয় না। এটি সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে। আর যারা করছেন তারা সভাপতি পদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছেন। এর সমাধান হলো একটি সাধারণ সভা দিয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা। তবে যেহেতু করোনার কারণে নির্বাচনের সমস্যা তাই সিনিয়র সহসভাপতিকে সভাপতি করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, এটি একটি সম্মানিত জায়গা। আমাদের সবার বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষা করা উচিত। আর যাকে হাত জাগিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে তার নিজের থেকে বলা আমি এ পদে বসতে চাই না। এতে উনার ও বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষা হবে।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট ও আইনজীবীদের মর্যাদা ও সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অবিলম্বে সিনিয়র আইনজীবী ও নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে এই পরিস্থিতির সমাধান হওয়া উচিত। তবে এ বিষয়ে সরকার সমর্থক একাধিক আইনজীবীর মতামত জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সুপ্রিম কোর্ট বারে সভাপতির পদ নিয়ে দু’পক্ষের আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি স্লোগান বিষয়ে গত ১ জুন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, সভাপতির পদ নিয়ে নোংরামি হচ্ছে। এ ধরনের রাজনীতি আমি চরমভাবে ঘৃণা করি। আমি সভাপতি থেকেই বারের সব উন্নয়নমূলক কাজ করেছি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বারের ৪৮ বছরের ইতিহাসে অনির্বাচিত কেউ সভাপতির চেয়ারে বসতে পারেননি। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন নয়। তিনি বলেন, দেশের কোথাও এখন নির্বাচন নেই, সুপ্রিম কোর্ট বারে নির্বাচনের মাধ্যমে আইনজীবীদের প্রতিনিধি নির্বাচন হচ্ছে তাও ভণ্ডুল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, সভাপতি পদ দখলের অপচেষ্টা বন্ধে আমরা আন্দোলন করছি। যতক্ষণ সভাপতি পদে নির্বাচন না হবে ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে। তিনি বলেন, আইনজীবী ফোরামসহ সব গণতন্ত্রকামী আইনজীবী দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ সেশনের সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনে ১৪টি পদের মধ্যে সভাপতি পদসহ আটটি পদে জয়ী হয় সরকার সমর্থক সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ (সাদা)। অন্য দিকে সম্পাদক পদসহ বাকি ছয়টি পদে জয়ী হয়েছে বিএনপি সমর্থক জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল)। সভাপতি পদে সাদা প্যানেলের প্রার্থী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর গত ১৫ মার্চ আবদুল মতিন খসরু করোনা টেস্ট করান। টেস্টে পজিটিভ আসার পর ১৬ মার্চ তিনি সিএমএইচে ভর্তি হন। ১৪ এপ্রিল আবদুল মতিন খসরু ইন্তেকাল করেন। ফলে সভাপতি পদটি শূন্য হয়ে যায়। পরে ২৭ এপ্রিল বিশেষ সাধারণ সভা আহ্বানের একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস (কাজল)।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি আবদুল মতিন খসরু ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করায় সমিতির গঠনতন্ত্রের ১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সভাপতির শূন্যপদ পূরণের লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণ শীর্ষক বিশেষ সাধারণ সভা ৪ মে বেলা ২টায় সমিতির শহীদ সফিউর রহমান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। সে অনুসারে ওই দিন বিশেষ সাধারণ সভা শুরু হলে সেখানে দু’পক্ষ হট্টগোল করে। সহসভাপতি শফিক উল্যাহর সভাপতিত্বে অ্যাটর্নি জেনারেল ও সাবেক সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিনকে সভাপতি নির্বাচিত করার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। তারা দাবি করেছেন সমিতির বিশেষ সাধারণ সভায় এ এম আমিন উদ্দিন কণ্ঠ ভোটে সভাপতি হয়েছেন। তবে সভা শুরুর পর এতে সভাপতিত্ব কে করবেন তা নিয়ে হইচই, হট্টগোল ও বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন কার্যনির্বাহী কমিটিভুক্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক পক্ষের আইনজীবীরা। এরপর সেই সভা মুলতবি করেন সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। এর পর থেকে দু’পক্ষের আইনজীবীরা বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে।
Leave a Reply