সময়টা সম্ভবত ২০১৪ সালের পর এবং ২০১৫ সালের মাঝে কোনো এক দিন। যতদূর মনে পড়ে ঘটনার দিন বেলা ১১টায় আমার তোপখানা রোডের অফিস থেকে নাবিস্কোর উদ্দেশে বের হয়েছিলাম। তখন মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছিল। ফলে রমনা থানার সম্মুখভাগ থেকে মগবাজার মোড় হয়ে তেজগাঁও সাত রাস্তা এবং সেখান থেকে তিব্বত-নাবিস্কো হয়ে একেবারে মহাখালী মোড় পর্যন্ত রাস্তাঘাটের দুরবস্থা, ট্রাফিক জ্যাম, জনদুর্ভোগ ইত্যাদি যে কয়েক বছর পর্যন্ত কোন পর্যায়ে ছিল তা ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। একই ফ্লাইওভারের কারণে বাংলামোটর থেকে নিউ ইস্কাটন হয়ে মগবাজার ওয়্যারলেস গেট, মৌচাক-মালিবাগ থেকে কাকরাইল এবং রাজারবাগ থেকে মৌচাক হয়ে রামপুরা ব্রিজের রাস্তার দুই পাশের জনজীবন রীতিমতো যেন ‘জাহান্নাম হয়ে’ পড়েছিল।
আমাদের দেশের ঠিকাদারদের অনভিজ্ঞতা-দুর্নীতি ও বেপরোয়া মনোভাব এবং সরকারি কর্তাদের একই চরিত্র ও মনমানসিকতার কারণে সরকারি নির্মাণকাজের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ইদানীংকালের মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রভৃতি মেগা প্রকল্পে যে জনদুর্ভোগ হচ্ছে, তা ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব যদি একজন মাত্র সৎ-মেধাবী-সাহসী সরকারি কর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন। বিদেশের কথা বাদ দিলাম- আমার নির্বাচনী এলাকায় মাত্র পাঁচ বছরে যেভাবে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণ, ৩০০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন, প্রায় ৫০০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে কয়েক শ’ পুল-কালভার্ট, ব্রিজসহ শত শত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছি সে কারণে পটুয়াখালীর গলাচিপা-দশমিনার জনগণকে উহ্ শব্দটি পর্যন্ত করতে হয়নি।
মাঠপর্যায়ে নিজের অভিজ্ঞতা এবং বৃহত্তর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সাথে যুক্ত থাকার কারণে যেকোনো নির্মাণের নেতিবাচক বা ইতিবাচক দিক খুব সহজে আমার চোখে ধরা পড়ে যায়। ফলে রাস্তায় বের হলে অহেতুক মনোবেদনা থেকে বাঁচার জন্য প্রায়ই গাড়িতে বসে চোখ বুজে থাকি। ঘটনার দিনও চোখ বুঁজে ছিলাম। হঠাৎ ড্রাইভার বলল- স্যার, কাকরাইল মোড় থেকে প্রধান বিচারপতির বাসভবন পর্যন্ত যেভাবে গাড়িগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তাতে মগবাজার মোড়ে যেতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে। তার চেয়ে মালিবাগ হয়ে মগবাজার এবং সেখান থেকে সাত রাস্তা-নাবিস্কোর পথে কম ট্রাফিক জ্যাম হতে পারে। আমি চোখ বুজেই ড্রাইভারকে বললাম, হুম, ঠিক আছে।
বেলা ১১টায় যাত্রা শুরু করে সে দিন নাবিস্কো পৌঁছালাম সন্ধ্যা ৭টায়। যাত্রাপথের পুরোটা সময় গাড়িতে বসে আমার কীসব শারীরিক-মানসিক এবং প্রাকৃতিক জটিলতা হয়েছিল তা নিয়ে সহযোগী একটি দৈনিক পত্রিকায় বিরাট এক নিবন্ধ লিখেছিলাম। এ ছাড়া অনেকটা অধৈর্য হয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ফোনও করেছিলাম আনুমানিক বেলা ৩টার সময়। মন্ত্রী আমার কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝেছিলেন যে, আমি কোনো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সুতরাং তিনি ধৈর্যসহকারে আমার কথা শুনলেন এবং বললেন, ‘বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অর্থাৎ মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের অধীন। গত চার-পাঁচ বছর ধরে এই জনদুর্ভোগ চললেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা তার প্রতিনিধি একটিবারের জন্যও সেখানে যাননি। অন্য দিকে ঢাকা সিটি করপোরেশন খোঁড়াখুঁড়ির অনুমোদন দিলেও, সেই খোঁড়াখুঁড়ি মেরামত করে চলনসই রাস্তা বহাল রাখার যে শর্ত ঠিকাদার কোম্পানিকে পালন করতে হয় তা তদারক করার চেষ্টাও কোনো সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা করেননি। সুতরাং যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে কী করতে পারি কেবল গালি খাওয়া ছাড়া।’ মন্ত্রীর কথার জবাবে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যা আসে তা দিয়েই তাকে পরামর্শ দিলাম যে, চলমান কোনো প্রকল্পে তার সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও তিনি কিভাবে জনদুর্ভোগ লাগবে জাদুকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন মন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের ‘ভরা যৌবন’। তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, পুলিশ-সাংবাদিক, নগরবিদ, পরিবেশবিদদের নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঘটা করে রাস্তায় বের হন এবং তার সেসব কর্ম সারা দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে। অন্য দিকে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন আমি বর্জন করেছিলাম এবং বিরোধী দলহীন ভোটারহীন নির্বাচনী কলঙ্কের ইতিহাসে যাতে আমার নামটি না থাকে সে জন্য আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপত্র পর্যন্ত কিনিনি। তার পরও দলটির হাইকমান্ড আমাকে ভালো জানতেন। আজকের ২০২১ সালের জুন মাসে এসে সেই ২০১৫ সালের ঘটনা মনে করার মূল কারণ হলো- সাম্প্রতিক সময়ের গণতন্ত্রহীনতা, সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব, সাংবাদিকতার নামে ক্ষমতার পদলেহন এবং ক্ষমতাধরদের বর্জ্য লেহনের জন্য মেধাহীন-চরিত্রহীন সাংবাদিক নামধারীরা যেভাবে বর্জ্যস্থলে গিয়ে সবার আগে সব কিছু উদরস্থ করার জন্য ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো দৌড়ায় তা কিন্তু মাত্র ছয়-সাত বছর আগেও ছিল না।
সংসদ সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও সরকারি দফতরগুলোতে আমার একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল। তখন প্রথম সারির তিনটি জাতীয় দৈনিকে প্রতি সপ্তাহে তিনটি উপসম্পাদকীয় লিখি, যা প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দফতরে নিয়মিত পাঠ করা হতো এবং ফাইল করা হতো। এ ছাড়া টকশো-সভা-সমিতিতে আমার বক্তব্যের যেমন অসংখ্য দর্শক-শ্রোতা ছিলেন, তেমনি সরকারি দফতরগুলো আমার বক্তব্যের প্রতিটি ভিডিও-অডিও ক্লিপ পর্যালোচনা এবং সংরক্ষণ করত। কেবল আমি নই, আমার মতো আরো জনাদশেক বক্তা কাম-লেখকের ব্যাপারে সরকার সর্বদা অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করত এবং সেটি কোন পর্যায়ের ছিল তা বুঝানোর জন্যই আজকের শিরোনামের অবতারণা করেছি।
আমি মন্ত্রীর সাথে কথা বলার পরের দিনই একটি জাতীয় দৈনিকে মগবাজার ফ্লাইওভারের দুর্ভোগ নিয়ে উপসম্পাদকীয় লিখলাম। সেখানে যাত্রাপথে আমার দুর্ভোগসহ নিত্যদিনকার অজস্র বিপদ-বিপত্তির ফিরস্তিসহ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে আমার কথোপকথনের বিষয়ে বিস্তারিত লিখছি। লিখাটি যেদিন প্রকাশিত হলো সে দিন বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ মন্ত্রী আমাকে সরাসরি ফোন দিলেন এবং অনুযোগের স্বরে বললেন, ‘রনি! তুমি নাকি আমাকে ফাটাকেষ্ট বলেছ? তা ছাড়া আমার বিরুদ্ধে নাকি আরো অনেক কথা লিখেছ। অথচ আমি তোমাকে সুন্দর করে সব কিছু বুঝিয়ে বললাম এবং আমার সীমাবদ্ধতাও জানালাম! তার পরও আমার বিরুদ্ধে লিখে আমাকে কেনো ডুবালে।’ মাননীয় মন্ত্রীর কথাশুনে আমি প্রথমে খুব আশ্চর্য হলাম। তারপর বললাম, কাদের ভাই! আপনি কি লিখাটা পড়েছেন? মন্ত্রী বললেন, আমি তোমার সব লেখা রাতে বাসায় গিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে কিছু লেখা মিস করি; কিন্তু তোমার ভাবী সকাল ১০টার মধ্যেই সব পত্রিকা পড়েন এবং তোমার লেখা থাকলে সবার আগে পড়েন।
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম- তাহলে ভাবী কি আপনাকে আমার লেখা সম্পর্কে কিছু বলেছেন? তিনি জানালেন, না তোমার ভাবী কিছু বলেনি। তোফায়েল ভাই (জননেতা তোফায়েল আহমেদ) ফোনে বললেন- ‘কাদের! আজকের ওমুক পত্রিকা পড়েছ! রনি তো তোমারে ডুবাইছে…। তোফায়েল ভাইয়ের কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গেছে তাই পত্রিকা না পড়েই তোমাকে ফোন দিয়েছি।’ কাদের ভাইয়ের কথা শুনে হেসে দিলাম। বললাম, এখনই পত্রিকাটি পড়ুন এবং আপনার লোকজনকে পড়তে বলুন। আমি আপনার প্রশংসা করে অনেক কিছু লিখেছি এবং কিভাবে মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা আপনি মেরামত করতে পারেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছি। মন্ত্রী আমার কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন এবং বললেন, ‘রাতে বাসায় গিয়ে তোমার লেখা পড়ব।’
কাদের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর আমি তোফায়েল ভাইকে ফোন দিলাম এবং আবদারের স্বরে বললাম- আপনি আমার পেছনে লেগেছেন কেন? আপনি কাদের ভাইকে ফোন করে কেনো বলেছেন, রনি তোমারে ফাটাকেষ্ট কইছে, তোমারে ডুবাইছে…। তোফায়েল ভাই আমার কথা শোনার পর তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, রনি! আমিতো ওসব কিছুই বলিনি। বরং বলেছি- কাদের! আজকের ওমুক পত্রিকা পড়ে দেখো! রনি তোমাকে নিয়ে অসাধারণ একটা লেখা লিখেছে। এতে কাদেরের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি না হয়ে ও কেন রাগ হলো, তা তো আমার মাথায় ঢুকছে না। তা ছাড়া সব লেখা যে সবসময় কারো পক্ষে যাবে, তেমন তো কোনো কথা নেই। আর লেখা বিপক্ষে গেলেই মন খারাপ করতে হবে- লেখককে ফোন করতে হবে! এটা তো ঠিক নয়। এই ধরো, তুমি তো আমার বিরুদ্ধে কত লিখেছ, কত কথা বলেছ! আমি কি কোনো দিন তোমাকে ফোন করেছি? তবে কাদের ফোন করল কেন…? তোফায়েল ভাইয়ের সঙ্গে কথা শেষ করার ঘণ্টাখানেক পরে জানলাম যে, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মগবাজার ফ্লাইওভারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট রাস্তা মেরামতের জন্য সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং টেলিভিশনে যোগাযোগমন্ত্রীর তৎপরতার দৃশ্য দেখার পর যতটা না আনন্দ অনুভব করলাম, তার চেয়েও বেশি সম্মানিত বোধ করলাম তখন, যখন দেখলাম, মন্ত্রীর দেয়া হুমকিতে কাজ হয়েছে এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাত দিনের মধ্যেই সড়কের বেশির ভাগ অংশ মেরামত করে দিয়েছে।
আজকের জমানায় সাংবাদিক রোজিনার অপমান, গ্রেফতার ও কারাবাসসহ সৎ সাংবাদিকতার দুর্দিনের প্রেক্ষাপটে যখন সাম্প্রতিক অতীতের কিছু ভালো উদাহরণ স্মরণ করি, তখন অনেক কিছুর কার্যকারণ মেলাতে পারি না। কারণ সেই মানুষ, সেই ক্ষমতা, সেই ইটপাথরের দালানকোঠা আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনি আকার-আকৃতিতে আগের মতোই তো মনে হচ্ছে। তবে কেনো ওখান থেকে আগের মতো সুবাস বের হয় না? কেনো ওগুলোর মধ্যে সূর্যালোক ঢোকে না? নির্মল বাতাস-পাখপাখালির কলরব, চাঁদের স্নিগ্ধ জোৎসা এবং মানবকণ্ঠের সুর লহরী কেনো ওসব এলাকায় প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না? ওখানে কেনো এত পুঞ্জীভূত ভয়, এত বেদনা হতাশা ক্ষোভ এবং ঘৃণার দুর্ভেদ্য জাল সৃষ্টি হয়েছে? কে বুনেছে ওই সব জাল, যা থেকে বের হওয়ার পথ পাওয়া যাচ্ছে না অথবা যা ভেদ করে ওসব এলাকায় প্রাণের স্পন্দন পৌঁছানো যাচ্ছে না!
সময়ের নির্মম জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষগুলোর আবেগ অনুভূতি এখন সবকিছু বাদ দিয়ে কেনো ঢাকার অদূরে নির্জন তুরাগ তীরে নৌকা ক্লাব নামের একটি কথিত ক্লাবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, তা আমার মাথায় ঢোকে না। মানুষ কেন শুভকর্মের চেয়ে মাতাল হয়ে জুয়াবাজি করার ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ সুবিধা পায়? পর্দানশিনের কান্না যেখানে মূল্যহীন এবং ধর্ম কথাকে যেখানে সন্দেহের চোখে দেখা হয় এবং যেখানে মধ্যরাতের মদ্যপ নারী-পুরুষের যৌনতার প্রতিযোগীদের ক্ষমতার দৌড় দেখার জন্য মানুষের উদগ্র বাসনার উত্তেজনা ভূমিকে প্রকম্পিত করে, সেখানে আপনার আমার মতো মানুষ কতকাল অতীতের রোমন্থন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা খোঁজার চেষ্টা করতে পারব, তা কেবল আসমানের মালিকই বলতে পারেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
Leave a Reply