আমরা জানি, বহুল প্রচলিত প্রবচনে নেপোলিয়ন বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে সুন্দর মা দাও, আমি তোমাদেরকে সুন্দর জাতি উপহার দেবো।’ অথচ তিনি সুন্দর মা হওয়ার নিয়মনীতি বা পদ্ধতির দিকনির্দেশনা দেননি। উন্নতমানের কারখানা ছাড়া উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করা যায় না। সে কারণে উন্নত জাতি গড়তে হলে উন্নত মা একান্ত জরুরি। কারণ মা-ই হলেন মানব উৎপাদনের সূতিকাগার। মহানবী সা: উন্নত মা হওয়ার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন- যে পথে মাতৃজাতিকে গড়ে তুললে উন্নত মা তৈরি হবে, উন্নত মা তৈরি হলে তৈরি হবে উন্নত সন্তান। তাহলে উন্নত জাতি তৈরি হবে। তবে এ কথা সত্য, প্রাণী জগৎ বিকশিত হওয়ার জন্য আল্লাহপাক যুগল বা মা-বাবা তৈরি করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে সন্তানের দায়ভার বা দায়িত্ব কেবল মাত্র মা-ই গ্রহণ করেন না। মা-বাবার সমন্বয়ে একটি পরিবারে শিশু লালিত হয়। তবে সন্তানের চরিত্র গঠনে মায়ের গুরুত্ব অধিক। মহানবী সা: সুন্দর, সুশীল ও উন্নত চরিত্রের জন্য মা-বাবা উভয়ের প্রতি দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। মহানবী সা: বলেছেন, (হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত) হিন্দা বিনতে ওতবা বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আবু সুফিয়ান অত্যন্ত কৃপণ লোক। আমি তার অজান্তে যা গ্রহণ করি, তা ছাড়া তিনি আমার এবং আমার সন্তানের জন্য প্রয়োজন মতো খরচ দিতেন না। (রাসূল সা: বললেন) তোমার ও তোমার সন্তানের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ (স্বামীর অজানা অবস্থায়) ন্যায়সঙ্গতভাবে গ্রহণ করতে পারো। (বুখারি ও মুসলিম) এ হাদিসের মর্মার্থ হলো- সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনে স্বামীর অজান্তে তার সম্পদ ব্যয় করার অধিকার স্ত্রীর আছে। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে- মহানবী সা: বলেছেন, উটের পিঠে সওয়ার হওয়ায় আরব নারীদের মধ্যে কুরাইশ নারীরাই উত্তম। অপর বর্ণনাকারী বলেন, কুরাইশ মহিলাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা নিজেদের শিশুসন্তানের প্রতি অধিকতর স্নেহশীলা এবং স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। (বুখারি)
হাদিস শরিফে হজরত জাবের ইবনে সামুরা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহ তোমাদের কাউকে ধন-সম্পদ দান করলে প্রথমে সে যেন তার নিজের এবং নিজের পরিবারের জন্য খরচ করে। (মুসলিম) এ হাদিসগুলোর ভাষ্যানুসারে সর্বোত্তম দান নিজের ও পরিবারের জন্য ব্যয় করা। সন্তানদেরকে সুশিক্ষিত করা, ন্যায় ও কল্যাণকর বিষয়ে শিক্ষা দেয়া। এভাবে পারিবারিক পরিমণ্ডলে মা-বাবার তত্ত্বাবধানে বিকশিত শিশুরা ব্যক্তিজীবনে আলোকিত হয়। সমাজকে আলোকিত করে। রাষ্ট্রের কল্যাণকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে থাকে। ফলে পারিবারিক পরিমণ্ডলের সুস্থধারায় বিকশিত শিশু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। আমরা জানি, একটি শিশু বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে আর পারিবারিক পরিমণ্ডলে আবদ্ধ থাকে না। সে তখন পরিবারের বাইরে সামাজিক পরিমণ্ডলে বিচরণ শুরু করে। এ সময় বাবা-মা সার্বক্ষণিকভাবে তার ওপরে নজরদারি করতে পারেন না। সচরাচর সামাজিক পরিমণ্ডলের বন্ধু-বান্ধব, বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ এ বয়সের শিশুদের প্রভাবিত করে। সে শিশু স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনে পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে নিজের সামর্থ্যানুযায়ী সেবা দিয়ে সাহায্য করে। সুষ্ঠু ধারায় প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় শিশুটি লালিত হলে তার মাঝে অপরাধপ্রবণতা দানা বাঁধতে পারে না। অপর দিকে অসুস্থ সমাজ ও অসৎ চরিত্রের বন্ধু-বান্ধবের পরিমণ্ডলে লালিত হলে শিশুটি নানাভাবে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সে কারণে বলা যায়, শিশুর বিকাশে ও কিশোর অপরাধ দমনে সমাজের বিশেষ দায় রয়েছে।
মানবজীবনে অর্থের প্রয়োজন অনেক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবন অর্থের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কেউ অর্থকে সৃষ্টিশীল কর্মে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে। আবার কেউ অর্থকে কুপথে ও অপকর্মে ব্যবহার করে। সমাজে অনেক ধনী ব্যক্তি আছেন যারা সন্তানদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অর্থের জোগান দিয়ে থাকেন। বাবা-মা যদি সন্তানের অর্থের ব্যয় খাতকে তদারকি করেন, সন্তানের বখে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আমরা জানি, কৈশোরকাল মানুষের জীবনে রঙিন স্বপ্নের জাল অঙ্কন করে। সে কারণে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে কৌত‚হলবশত দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। পারিবারিকভাবে বাবা-মা ও সামাজিকভাবে পারিপার্শি¦ক সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিরা সচেতন হলে কিশোরদের এ ধরনের মানসিকতা অনেকাংশে অবদমিত হতে বাধ্য। আমরা অনেক ক্ষেত্রে কিশোরদের দুঃসাহসিকতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমাজ অধিপতিরা অনেক ক্ষেত্রে কিশোরদের অল্প অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ সমাজবিরোধী অপরাধমূলক কাজে নিয়োগ করে থাকেন। আমরা জানি, অপরাধ সংঘটিত করতে দাগী মাস্তান ব্যবহার করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। অথচ কিশোর ছেলেমেয়েদের দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অল্প অর্থে এসব অপরাধ করা যায়। এ কারণে কিশোর সমাজ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষকে লালন করার সার্বিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সঠিকভাবে কিশোরসমাজ বিকশিত হতে পারলে পরে তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। সুনাগরিকের মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনাগার আছে, যেসব সংস্থা মূলত সুব্যবস্থাপনার অভাবে বন্দিশালা; এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংশোধনের পরিবর্তে অপরাধ সংগঠনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি যশোর কিশোর অপরাধ সংশোধনাগারে তিন কিশোরকে দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, সংশোধনাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে হইচই পড়ে গেছে।
শিক্ষা আলো, শিক্ষা শক্তি। শিক্ষা জীবনে চলার পথপ্রদর্শক। মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা-ই হলেন তার ‘প্রধান শিক্ষক’। সে কারণে একজন আদর্শ মা তার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। মহানবী সা: সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে মায়ের অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কোনো পরিবারে স্বামী-স্ত্রীতে বিচ্ছেদ ঘটলে সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে তিনি মায়ের অভিভাবকত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বর্তমান আধুনিক সমাজে মায়েরা সন্তানের দায়িত্ব নিতে চান না। তারা কাজের বুয়াকে দিয়ে অথবা শিশুসদনে সন্তান লালন-পালনে আগ্রহী। একজন মা যে দরদ ও মমতা দিয়ে তার সন্তানের চাহিদা পূরণ করতে পারেন, পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ দিয়ে সে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। সে কারণে মাতৃস্নেহ বর্জিত শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে অপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। শৈশবের শিক্ষা কৈশোর জীবনকে প্রভাবিত করে। মাতৃ-পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত এসব শিশু কৈশোরকালে সহজেই অপরাধপ্রবণতায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। সে কারণে কিশোর অপরাধ দমন করতে পারিবারিকভাবে বিশেষত মায়ের ভূমিকা অপরিসীম।
ধর্মীয় অনুশাসন বাহ্যিক ও আত্মিকভাবে বিকশিত হয়। যেকোনো শিশু শৈশবে পরিবার বাবা-মা, বিশেষত মায়ের বাহ্যিক আচরণকে অনুকরণ করে। ধর্মীয় আচরণে পরিচালিত পরিবারে শিশু তার মায়ের পরিচ্ছন্নতা, ধর্মীয় আচরণ তথা ইবাদত-বন্দেগিকে অনুসরণ করে। আমরা দেখি, অনেক শিশু তার মায়ের নামাজ আদায়ের বাহ্যিক অঙ্গ সঞ্চালনের অনুসরণ ও অনুকরণ করে থাকে। বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু পরিবার, বাবা-মা বিশেষত মায়ের জীবনাচরণের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। তার শৈশবের এ জীবনাচরণ কৈশোর জীবনকেও প্রভাবিত করে। সে কারণে শিশুর মনোবিকাশে ও জীবনাচরণে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিফলন ঘটলে কৈশোর জীবনে সে অপরাধপ্রবণতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কিশোর অপরাধ দমনে আমাদের শৈশব থেকেই শিশুকে ধর্মীয় অনুশাসনে লালন করতে হবে। তাহলে কৈশোর জীবনে সে বহুলাংশে অপরাধপ্রবণতা থেকে মুক্ত থাকবে। ফলে পরিবার, সমাজ ও জাতি উপকৃত হবে।
ইন্টারনেট সমগ্র পৃথিবীর মানবসমাজকে পরিবেষ্টন করে ফেলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জালে আবদ্ধ মাছ কোনো অবস্থাতেই জাল থেকে বের হতে পারে না। বর্তমান মানবসমাজ তেমনই ইন্টারনেটের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারছে না। আবালবৃদ্ধবনিতা এ জালে আবদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুপরিচর্যার ক্ষেত্রেও ইন্টারনেটের প্রভাব পড়ছে। যেমন- টিভি অথবা মোবাইল চালু করে একটি শিশুকে তা দেখার ব্যবস্থা করে পারিবারিক সদস্যরা ঘর গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে কারণে শৈশবকাল থেকে শিশুরা ইন্টারনেটের জালে বন্দী হয়ে পড়ছে। আর কৈশোর তো রঙিন জীবন। স্বপ্নচারিতা ও স্বপ্নবিলাস কৈশোরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সে কারণে শৈশবের আচরণ সহজেই কৈশোর জীবনে সঞ্চালিত হয়। শৈশবের ইন্টারনেটের প্রভাব কৈশোর জীবনে বিকশিত হয়, যে কারণে ইন্টারনেটের প্রভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিশোররা অপরাধপ্রবণতায় ঝুঁকে পড়ে। ইন্টারনেটের প্রভাব থেকে শিশু ও কিশোরদের মুক্ত রাখতে পারলে অথবা সুচিন্তামূলক ও সুশীল চেতনার গণমাধ্যম চালু করতে পারলে কিশোর অপরাধ অনেকাংশে দমন করা সম্ভব হবে।
বর্তমান সমাজে কিশোর গ্যাং ও কিশোর ক্লাব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেট ও পারিপার্শ্বিকতায় প্রভাবিত হয়ে নিজেরাই বিভিন্ন নামে গ্যাং ও ক্লাব গড়ে তুলছে। এসব গ্যাং ও ক্লাব সুপথে পরিচালিত হলে কিশোরদের দ্বারা সমাজ ও জাতি উপকৃত হতো। অথচ সামাজিকভাবে আমরা কর্মকাণ্ডকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করছি না। ফলে উঠতি বয়সের এসব ছেলে-মেয়ে বিভিন্নভাবে পালছেঁড়া নৌকার মতো দিকহারা হয়ে নিজেদের চারিত্রিক সুবৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সংবাদমাধ্যমে মাঝে মধ্যেই আমরা কিশোরদের মাধ্যমে আতঙ্কজনক অপরাধপ্রবণতার খবর ও ছবি পেয়ে থাকি। এভাবে কিশোরসমাজ অপরাধপ্রবণতায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়লে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। সময় থাকতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ
Leave a Reply