ইসলামাবাদের জিন্নাহ এভিনিউতে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। একজন নারী কোলে কয়েক মাসের শিশু এবং অপর হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা উঁচিয়ে ধরে রেখেছিলেন। শিশুটি তার মায়ের হাতে ধরে থাকা পতাকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। এক পাকিস্তানি শিশু তার মায়ের কোলে ফিলিস্তিনকে জানছিল। ওই নারীর কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বোন, আপনি এই সমাবেশে আপনার ছোট্ট শিশুকে কেন নিয়ে এসেছেন? ওই নারী দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমি আমার কোলে শিশুকে সামনে ধরে ফিলিস্তিনের ওই মায়েদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে এসেছি, যাদের শিশুরা ইসরাইলের বোমাবর্ষণে শহীদ হয়েছে। এক ছোট্ট বালিকা তার মাথার উপর কাগজের একটি মুকুট পরেছিল। ওই মুকুটে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’। আমি ওই ছোট্ট বালিকাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার মুকুটে কী লেখা আছে? মেধাবী বালিকাটি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো, এটা নিজের হাতে লিখেছি। আমি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই। আমি প্রশ্ন করলাম, মা, আপনি কোন ক্লাসে পড়েন? ছোট্ট বালিকাটি বলল, আঙ্কেল আমি পড়ি তৃতীয় শ্রেণীতে। ১৬-১৭ বছরের এক কিশোর তার ডান গালে ফিলিস্তিন ও বাম গালে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে রেখেছে। সে জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছিল, ‘ইসরাইল মুর্দাবাদ’। ওই কিশোরকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে এই বিক্ষোভ সমাবেশে কার কথায় এসেছে? তার স্লোগানে ফিলিস্তিনিদের কী লাভ হবে? ওই কিশোর জবাব দিলো, আমার বন্ধুদের সাথে সকালে ঘর থেকে বের হয়েছি। এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য তিনটি সমাবেশে শরিক হয়েছি। এ সময় লাউড স্পিকারে সমাবেশে বক্তৃতা প্রদানকারী এক বক্তার কণ্ঠ গর্জে উঠল। তিনি কবিতা পাঠ করছিলেন- হ্যায় খাকে ফিলিস্তিন পে ইয়াহুদি কা আগার হাক/হাসপানিয়া পার হাক নাহি কিউ আহলে আরাব কা- ফিলিস্তিন ভূমির ওপর যদি ইহুদিদের অধিকার থাকে, তাহলে স্পেনের ওপর আরবদের অধিকার নেই কেন?- কবিতাটি শুনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরতাজা তরুণ ছেলেটি আরো আবেগ ও উত্তেজনা নিয়ে স্লোগান দিলো, ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’। আমি বললাম, বলো তো, এ কবিতাটি কার? তরুণটি মুচকি হাসল। বলল, জনাব, কবিতাটি আল্লামা ইকবালের। আমার দাদা বলেছেন, আল্লামা ইকবাল মসজিদে আকসায় নামাজও আদায় করেছেন। আমি আমার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম। ২১ মে পাকিস্তানজুড়ে ফিলিস্তিন দিবস পালন করা হচ্ছিল। শহরে শহরে ওই দিন মিছিল সমাবেশ হয়েছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে তো সারা বিশ্বজুড়ে মিছিল সমাবেশ হচ্ছে, কিন্তু তাদের পক্ষে যত মানুষ পাকিস্তানে বের হয়ে এসেছে, কয়েকটি আরব দেশেও এত লোক বের হয়নি। এমন মিছিল ২২ মে’তেও বের হয়। ২৩ মে করাচির মিছিল ও সমাবেশ ছিল নজিরবিহীন। প্রতিটি সমাবেশে ফিলিস্তিনের পাশাপাশি কাশ্মিরের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণ বংশ পরম্পরায় ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছে। কিছু আরব দেশের বাদশাহ চান, পাকিস্তান ও ইসরাইল পরস্পরের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করুক। কিন্তু এ বাদশাহরা জানেন না, যে কবি পাকিস্তানের ‘স্বপ্ন’ দেখেছিলেন, সেই কবি তার জীবদ্দশায় আমাদের সতর্ক করে গেছেন এই বাদশাহদের কথা না শুনতে। ‘প্রাচ্যের কবি’ আল্লামা মুহম্মদ ইকবালের জীবনে ১৯৩১ সাল ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছর ১৪ আগস্টের দিন তিনি লাহোরের একটি সমাবেশে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করেন এবং ওই বছর ৬ ডিসেম্বর ইকবাল ইসলামী সংস্থার পক্ষ থেকে ফিলিস্তিন বিষয়ে আয়োজিত কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য জেরুসালেম পৌঁছেন। আল্লামা ইকবাল বায়তুল মুকাদ্দাসের সন্নিকটে হোটেল মারকুসে অবস্থান করেন। ১৯৩১ সালের ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বায়তুল মুকাদ্দাস সংলগ্ন রুফতা আল-মাসারিফে ইসলামী সংস্থার পরিচিতি বৈঠক হয়েছিল। এর পর ইকবাল মসজিদে আকসায় যান। প্রথমে তিনি মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহারের কবর জিয়ারত করেন। এরপর মসজিদে আকসায় মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। তারপর এখানেই তিলাওয়াত ও নাতে রাসূল পাঠের এক মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন। এশার নামাজও এখানেই আদায় করেন। সবশেষে আল্লামা ইকবাল সব অংশগ্রহণকারীসহ হাত উত্তোলন করে শপথ করেন, তিনি পবিত্র স্থানের হেফাজতের জন্য নিজের জীবন কুরবান করে দেবেন। ইকবাল সাত দিন পর্যন্ত ইসলামী সংস্থার বৈঠকগুলোতে অংশগ্রহণ এবং প্রতিদিন মসজিদে আকসায় গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এখানে কয়েকবার তিনি স্পেনবিজেতা তারিক বিন জিয়াদ সম্পর্কিত তার ফারসি কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনান। যখনই তিনি এই কবিতা শোনাতেন, তখন একজন ইরাকি আলেমে দীন আরবি অনুবাদ করে দিতেন। আল্লামা ইকবাল কায়রো হয়ে ভারত ফিরে এলেও আমৃত্যু ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসার সাথে তার আত্মার সম্পর্ক অটুট ছিল। ১৯৩৭ সালের ৩ জুলাই তিনি রয়েল কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে এক তফসিলি বক্তব্য প্রদান করেন। ওই বক্তব্যে তিনি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটেনের অপচেষ্টার প্রকাশ্যে নিন্দাজ্ঞাপন করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন, এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে তুরস্ক ও আরবরা পরস্পর জোট গঠন করবে। ওই বক্তব্যে আল্লামা ইকবাল বলেন, আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। আরবদের উচিত নিজেদের জাতীয় সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় আরব দেশগুলোর বাদশাহদের পরামর্শের ওপর ভরসা না করা। কেননা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাদশাহ এই যোগ্যতা রাখেন না যে, তিনি নিজের বিবেক ও ঈমানের আলোকে ফিলিস্তিন সম্পর্কে কোনো সঠিক ফায়সালা করতে পারবেন।
মৃত্যুর কয়েক মাস আগে আল্লামা ইকবাল ৭ অক্টোবর, ১৯৩৭ কায়েদে আজমের নামে পাঠানো পত্রে ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে তার অস্থিরতার কথা প্রকাশ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ফিলিস্তিন বিষয়ে শুধু প্রস্তাবাবলি মঞ্জুর করবে না বরং এমন কিছু করবে যাতে ফিলিস্তিনি আরবদের উপকারও হয়। কায়েদে আজম শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য ফান্ডই গঠন করেননি বরং ১৯৩৭ সালের ৩ ডিসেম্বর সমগ্র ভারতে ফিলিস্তিন দিবস পালন করেন। এর আগে ১৯৩৬ সালের ১৯ জুনও ফিলিস্তিন দিবস পালন করা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ আগস্টও ফিলিস্তিন দিবস পালন করা হয়।
এরপর ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাবের পাশাপাশি ফিলিস্তিন প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল। এ কারণেই ১৯৪৮ সালে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি সাচ্চা পাকিস্তানির রক্তে মিশে আছে। কেননা এ ভালোবাসা বংশ পরম্পরায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লামা ইকবালের ফিলিস্তিন স্বাধীন না হবে, ততক্ষণ জিন্নাহর পাকিস্তান কোনো আরব বাদশাহ বা কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইচ্ছার গোলাম হতে পারবে না।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৪ মে, ২০২১ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট, জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)
Leave a Reply