বাংলাদেশ থেকে ভালো খবর পাই না, রোজই যাদের মৃত্যুর খবর পাই, তাদের মধ্যে অনেকেই আমার পরিচিত। একজনের মৃত্যুর শোকের আঘাত না সইতেই আরেকজনের মৃত্যুর খবর আসে। গত শনিবার খবর পেলাম বিশিষ্ট সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার আর নেই। করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনিও চলে গেছেন। হাসান শাহরিয়ার বয়সে আমার চেয়ে ছোট। বয়সের সীমা পেরিয়ে আমরা বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। গত বছর ও এ বছর এত বন্ধু হারিয়েছি যে, শোকস্তব্ধ হয়ে মনে হয় নব্বই বছর বয়সের কাছাকাছি পৌঁছে আমার বেঁচে থাকাটা একটা বড় বিস্ময়।
‘এতো মৃত্যু বাংলাদেশ দেখেনি কখনো।’ জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন একটু পাল্টে এখানে উদ্ধৃত করলাম। মনে করেছিলাম এ মৃত্যুদানবের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ একাট্টা হয়ে যুদ্ধে ব্যস্ত, অন্যদিকে সময় দেওয়ার অবস্থা তাদের নেই। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখছি, এ মৃত্যু উপত্যকাতেও চলছে ছোট-বড় জাগতিক বিষয় নিয়ে লড়াই। রাজনৈতিক লড়াই তো আছেই। সরকারও সর্বশক্তি নিয়ে মৃত্যুদানব করোনা মহামারির দিকে নজর দিতে পারছে না। তাকে রাজনৈতিক ইঁদুর ও ছারপোকা নিধনের দিকেও নজর দিতে হচ্ছে। ইঁদুর ও ছারপোকা ছোট প্রাণী বটে। কিন্তু তাদের উপদ্রব অসহনীয়।
এটা সত্য, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সঙ্গবদ্ধ বিরোধিতা নেই। কিন্তু এ খণ্ড-ক্ষুদ্র বিরোধিতাগুলো ইঁদুর ও ছারপোকার মতো উৎপাত হলেও সরকারকে তা বিব্রত করছে। এ ইঁদুরদের মধ্যে কিছু কিছু আবার সরকারের গৃহপালিত ইঁদুর। নিজের ঘরেই এরা বাঁধ কাটতে চাইছে। তাই বলছি, দেশের অবস্থাটা তেমন ভালো নয়। একদিকে মহামারি, অন্যদিকে সরকারের জন্য বিব্রতকর খণ্ড-ক্ষুদ্র বিরোধিতা। সেইসঙ্গে নিত্যগুজব প্রচার ও কানকথা দ্বারা সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা। আর তাদের সাহায্য জোগাচ্ছে নিরপেক্ষতার ঢালের আড়ালে একটি-দুটি দৈনিক পত্রিকা। তারা দেখিয়েছেন, তাদের অপপ্রচার দ্বারা কীভাবে ইউনিয়ন পরিষদের এক অখ্যাত মেয়রকেও জিরো থেকে হিরো বানানো যায়। স্ট্রিট কর্নারের এক মেগাফোন-বক্তাকে তারা এভাবে ‘রাজনীতির বীর নেতা’য় পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। কথায় বলে ‘প্রকৃত গায়কেরা যেখানে নেই, সেখানে ভেকেরাই শ্রেষ্ঠ গায়ক।’ বাংলাদেশে এখন তাই হয়েছে।
দুর্ভাগ্যের কথা, আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীন ও সংগ্রামী রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও তাদের সরকার দেশে রাজনৈতিক শূন্যতার বিপদ উপলব্ধি করছে না। এ বিপদ উপলব্ধি করেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। স্বাধীন ভারতের প্রথম পার্লামেন্টে বিরোধী দল ছিল না বললেই চলে। কংগ্রেসই ছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ একমাত্র দল। নেহেরু ভয় পেয়ে তার বিরোধী সমাজতন্ত্রী দলের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে ডেকে এনে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, ‘জয়প্রকাশ, আপনি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করুন। নইলে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেবে এবং পার্লামেন্টে আমার সরকারি দলের কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না। ফলে দলের নেতা ও কর্মীরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবেন। অন্যদিকে মাঠে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের শূন্যতা পূরণ করবে সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুত্ববাদী দলগুলো। তারা ক্রমে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভারত গঠন করার সব প্রচেষ্টা নষ্ট করে দেবে।’
নেহেরু তার এ রাজনৈতিক উপলব্ধি থেকে ভারতে শুধু বিরোধী দল গঠনেই উৎসাহ দেননি, ত্রিপুরা, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার পর্যন্ত গঠন করতে দিয়েছেন। একটি গণতান্ত্রিক ও বুর্জোয়াশাসিত দেশে কোনো রাজ্যে কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় বসতে দেওয়া এক অকল্পনীয় ও অভূতপূর্ব ঘটনা। ভারতে তাই আজ হিন্দুত্ববাদী দল ক্ষমতায় এলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই তাকে কাজ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর অসাম্প্রদায়িক দ্বিদলীয় রাজনীতি শক্তিশালী হয়নি, তার কারণ দর্শাতে গিয়ে অতীতের ইতিহাস নতুন করে টানতে চাই না, বরং হাল আমলের কথাই বলি। আওয়ামী লীগ সরকার একটি গণতান্ত্রিক সরকার হয়েও তাদের গত তিন দফার শাসনামলেও দেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে গড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। বিএনপি ও জামায়াত গোষ্ঠী শুধু সাম্প্রদায়িক নয়, বরং ধর্মকে তাদের রাজনীতিতে পুঁজি করে দেশের স্বাধীনতার মূল আদর্শেরই বিনাশ ঘটাতে চায়, একথা সত্য। এজন্য কঠোর হাতে এ ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে দমন করে সরকার গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছে তা আমি মনে করি না। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতকে দমন করার পাশাপাশি দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ যাতে বন্ধ না হয়, সেদিকেও সরকারের লক্ষ্য রাখা উচিত ছিল।
ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম বা ডা. বি. চৌধুরীর বিকল্পধারাকে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে গড়ে উঠতে দিলে সরকারের ক্ষতি ছিল না। অবশ্য এ দুই দলের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা দলের দুই নেতার ব্যক্তিগত হাসিনাবিদ্বেষ এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে তাড়ানোর জন্য চক্রান্তের ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে হাত মেলানো। এ দল দুটি এবং তাদের সমমনা কিছু দল তাদের নেতাদের কার্যকলাপের জন্যই রাজনীতির মাঠ থেকে ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে। সরকারকে এজন্য কোনো তৎপরতা দেখাতে হয়নি। কিন্তু একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের শাস্তিদানের দাবি নিয়ে বিরাট গণআন্দোলনের মাধ্যমে এবং তরুণ প্রগতিশীল নেতৃত্বে যে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ গড়ে ওঠে, তাকে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে প্রথম দিকে ব্যবহার করে পরে আওয়ামী লীগ সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে। এ গণজাগরণ মঞ্চ যাতে একটি গণতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসাবে গড়ে না ওঠে, সেজন্য সরকার একটি কৌশল গ্রহণ করে। একটি ধর্মান্ধ দলকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয় এবং গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার জন্য কাজে লাগায়।
আমার ধারণা, সরকার গণজাগরণ মঞ্চকে ভেঙে দিয়েছে এ ভয়ে যে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রেরণায় নবপ্রজন্মের তরুণদের দ্বারা গঠিত গণজাগরণ মঞ্চ দ্রুত জনসমর্থন অর্জন করে শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে ক্ষমতায় বসবে। সুতরাং আঁতুড়ঘরেই দলটিকে মেরে ফেলা দরকার। সম্ভবত এ চিন্তা-ভাবনা থেকে গণজাগরণ মঞ্চকে আঁতুড়ঘরেই মেরে ফেলা হয়েছে এবং এ মেরে ফেলার কাজটি সহজ করার জন্য স্বাধীনতার আদর্শবিরোধী একটি দলকে মাথা তুলতে দেওয়া হয়েছে। পরিণতি সরকারের জন্য আরও বড় শত্রু তৈরি হওয়া, যে শত্রু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিনাশ চায়। তারা আওয়ামী লীগেরও আসল শত্রু। আপাতত কপট মিত্র।
শাহবাগের গণআন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ যদি কোনোদিন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে গড়ে উঠে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাতেও বসত, তাতে দেশ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কোনো ক্ষতি হতো না। বরং একই আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত দুই দলের বা বহুদলীয় গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠিত হতো। আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় ফিরে আসত। কিন্তু এখন রাজনীতির মাঠে শূন্যতা পূর্ণ করেছে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার নীতিতে বিশ্বাসী রাজনৈতিক গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগকে যদি কোনো কারণে ক্ষমতায় ধরে রাখা না যায়, তাহলে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হবে এক আধা-তালেবান গোষ্ঠী। বিএনপি-জামায়াতের শাসনের চেয়েও যাদের শাসন হবে ভয়ংকর।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ভারতের কংগ্রেসের পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস দল এবং কংগ্রেস সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে দূরে সরতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী নরসীমা স্বয়ং কপালে তিলক এঁটে নিজেকে খাঁটি হিন্দু প্রমাণের চেষ্টায় উঠে-পড়ে লেগে যান। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বলেন, ‘ওটা রাজ্য সরকারের ব্যাপার। আমাদের কিছু করার নেই।’ দিল্লিতে বিজেপির ক্ষমতা দখলের পথটি সুগম করে যান নরসীমা রাও নিজেই।
বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলতে চাইলে আগে আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে ফিরে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাইলে আওয়ামী লীগকে আগে প্রকৃত গণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। দেশকে বাঁচাতে চাইলে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির শূন্যতা পূরণে আওয়ামী লীগকেই এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানের রাজনৈতিক ইঁদুর ও ছারপোকার উপদ্রব বন্ধ করতে চাইলে বিকল্প গণতান্ত্রিক দল গঠনকে স্বাগত জানাতে হবে।
লন্ডন, রোববার, ১১ এপ্রিল ২০২১
Leave a Reply