সহস্র বছরের বাংলায় পারস্পরিক আত্মিক ও চিৎপ্রকর্ষগত আটপৌরে বাঙালির অন্তরের সংযোগ ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার অনন্য সম্পদ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বি-জাতিতত্ত্বের সুবিধায় পাকিস্তানপন্থিদের চুয়ান্ন শতাংশ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবহেলা ভরে সরিয়ে রেখে মাত্র সাত শতাংশের উর্দু সংস্কৃতি চাপানোর বিপক্ষে গর্জে উঠেছিলেন এক সাহসী পুরুষ। বিশ্বনন্দিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে ছিল ২২১৭ কিলোমিটারজুড়ে (পশ্চিমবঙ্গের অংশ) র্যাডক্লিফ লাইনের অপর প্রান্তে দাঁড়ানো হৃদয়ের সম্পর্কযুক্ত বিপুল বাঙালির সংকল্প।
তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভাগ্যবিড়ম্বিত স্বজাতির পাশে সবকিছু উজাড় করে দাঁড়িয়েছিল কলকাতা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলকাতাবাসীর নেপথ্য নায়ক ছিলেন ‘শেখ মুজিব’। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বিশ্ব চমকিত। বঙ্গভূমি উদ্বেলিত। শিহরিত বাঙালির অখণ্ড জাতিসত্তা। কিন্তু বাংলার বন্ধু অনুপস্থিত। কলকাতা অপেক্ষায়, কখন আসবেন রাজনীতির কবি! সবার মধ্যে আকুলতা। অতঃপর বঙ্গবন্ধু এলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশে ফেরার পথেই ঘটল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার কূটনৈতিক ইতিবৃত্তের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে লন্ডন, অতঃপর দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ তার আজন্মলালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরা। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের চিরমুক্তির জন্য তার মাত্র ৫৫ বছরের জীবনকালের মধ্যে ৪৮৪৬ দিন কারাবাস করেছেন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ল, অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু করল, ঠিক তখনই, ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু।
যথাসময়ে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে জেনারেল নিয়াজির বাড়ির কাছে মিয়ানওয়ালি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ২৯০ দিন আটকে রাখে। অবশেষে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে ভুট্টোর কূটচাল এড়িয়ে সিহালা অতিথি ভবনে বিশ্রাম নিয়ে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ১০ ঘণ্টা পর লন্ডন যান।
বঙ্গবন্ধুকে দিল্লি যেতে হবে, কারণ যুদ্ধকালীন পরম বন্ধুরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার পারিষদ নিয়ে অপেক্ষা করছেন সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রের মহানায়ককে স্বাগত জানাতে। লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেল থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের দেওয়া একটি রাজকীয় বিমানে বঙ্গবন্ধু দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তাকে স্বাগত জানান সস্ত্রীক ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা শ্রী ডি.পি. ধর, শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়, বিদেশ সচিব শ্রী টি.এন. কাউল, রাজনৈতিক উপদেষ্টা শ্রী পি.এল. হাকসার, চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল মানেকশ এবং গোয়েন্দাপ্রধান শ্রীরামনাথ কাওসহ অনেকে।
রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের উপস্থিত করে চমক দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তারপর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে দিল্লিতে রচিত হলো একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে ভাষণ শুরু করলে হাজার হাজার জনতা দাবি তুলল-‘বাংলা-বাংলা’। এরপর বঙ্গবন্ধু ‘আমার ভাই ও বোনেরা’ বলে আবেগঘন ভাষণ দিয়ে দিল্লিবাসীদের মুগ্ধ করলেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মাত্র বারো ঘণ্টা অবস্থান করেন। লন্ডন থেকে দিল্লি ফেরার পথেই শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু সফলতার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন সৃজন করলেন। বাংলাদেশ থেকে ৩০ জুন ১৯৭২-এ ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের ক্ষণ পূর্বেই নির্ধারিত ছিল।
স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উত্থাপন করেন এবং তখনই ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের নির্ধারিত তারিখ ৩০ জুন ১৯৭২-এর পরিবর্তে তিন মাস এগিয়ে ৩১ মার্চ ১৯৭২-এ নির্ধারণ করার কথা আসে। ৯ জানুয়ারি ১৯৭২-এ লন্ডন থেকে দিল্লি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ৯ ঘণ্টা ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন ভারতের কূটনীতিক শ্রী শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি।
বঙ্গবন্ধুর স্বভাবজাত অতুলনীয় আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মি. ব্যানার্জি ছিলেন অভিভূত। অন্তরঙ্গ আলোচনার মাধ্যমে মি. ব্যানার্জি প্রথম জানলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। আলাপ জমিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ থেকে দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহারের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি মিসেস গান্ধীকে অবহিত করতে মি. ব্যানার্জিকে জানিয়ে রাখলেন। মি. ব্যানার্জি দিল্লি পৌঁছেই সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি মি. ডি.পি. ধরকে জানালেন। মি. ধর বিষয়টি বাংলাদেশের পরমবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে জানালেন। এ ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধী ইতিবাচক উত্তর দিলেন। বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হলেন।
কলকাতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আশৈশব সম্পর্কের নতুন বিন্যাস রচিত হয় দুই পর্বে। এক. বঙ্গবন্ধু ছাত্র বয়সে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। তিনি ১৯৪২-এ গোপালগঞ্জের মিশনারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশের পর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪-এ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন এবং ১৯৪৭-এ স্নাতক হন।
এ কলেজে অধ্যয়নকালেই বঙ্গবন্ধু ১৯৪৩-এ সর্বভারতীয় মুসলিম লিগের কাউন্সিলর এবং ১৯৪৬-এ ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দুই. মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বাধীন ‘রাষ্ট্র’ ঘোষণা ২৭ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকায় ব্যানার ‘হেড’ হয়েছিল। এ নিছক ঘোষণা নয়। বিশাল পুরুষের বিশাল অঙ্গীকার।
বঙ্গবন্ধুর ওই প্রত্যয়, ওই ঘোষণার বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বহু অংশে। কলকাতার সব দৈনিকের শীর্ষ সংবাদে সেদিন কেবল বঙ্গবন্ধু আর তার নিনাদিত কণ্ঠস্বরের বৃত্তান্ত। ছাত্র জমানার মুজিবকে বঙ্গবন্ধু আর শেখ মুজিবের উদ্দীপ্ত চেহারায় দেখতে পেয়ে একাত্ম হয়ে জাগ্রত আর লড়াকু বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াল সহমর্মী সহোদর পশ্চিমবঙ্গ।
কলকাতার বিবেক উচ্ছ্বসিত হলো এক অভূতপূর্ব অনুভূতিতে। এ মহানগরীতেই বাংলাদেশের প্রথম সরকার গড়ে উঠল ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল। বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হলো কলকাতায়। প্রথম সরকারের প্রধান কার্যালয় হলো কলকাতার ৮ থিয়েটার রোড এবং ৯ সার্কুলার অ্যাভিনিউতে (বর্তমানে বাংলাদেশ মিশন, ৯ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরণি)।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেওয়ার পর কলকাতার পাকিস্তান মিশনের ৬৫ জন বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশের মিশন ঘোষণা করলেন। বিশ্ব মিডিয়ায় নতুন মাত্রা পেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু তখন পাক কারাগারে বন্দি হলেও তার শারীরিক অনুপস্থিতিতে স্বাধীন সরকারের যাবতীয় কর্মযজ্ঞের সর্বময় কর্তৃত্ব ও অধিকারে ব্যাঘাত ঘটেনি। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে গোটা শহর এক হয়ে একস্বরে বঙ্গবন্ধুর ধ্যান আর সাধনাকে বরণ করল নিঃসংশয়ে। শহরের নানা জায়গায় আশ্রয়দাতা আর আশ্রিতের মিলন উল্লাস।
বাংলাদেশের মানুষের নেতা হিসাবে স্বীকৃত ওই একজনই-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, যার ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে জেগে উঠল নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেই ভূখণ্ডের উদ্বেলিত জনতার প্রিয় নেতার জন্য অবিরাম প্রতীক্ষা। বঙ্গবন্ধু তা জানতেন। তবুও তিনি লন্ডনের হোটেলেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘আমি এখানে এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই, আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু তার মনের গভীরে থাকা কলকাতাকে পাশ কাটিয়ে প্রাণের জনতার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ চাওয়া মিসেস গান্ধীকেও জানিয়ে দেওয়া হলো।
দিল্লি থেকে ঢাকাগামী বিমান পশ্চিমবঙ্গের আকাশে আসামাত্র বঙ্গবন্ধু ককপিটে গিয়ে পাইলটের সহায়তায় দমদম এয়ারপোর্টে বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন-যত দ্রুত সম্ভব তিনি প্রিয় কলকাতা আসবেন। দমদম এয়ারপোর্টেই বিশেষ ব্যবস্থায় নির্মিত মঞ্চের মাইকে বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত বার্তা আকাশবাণীর প্রতিনিধির মাধ্যমে বিপুল জনতাকে জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধু কলকাতায় এলেন ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। ছুটির দিন রোববার। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিট পরেই বঙ্গবন্ধু এসে পৌঁছালেন। বিমানবন্দর থেকে মোহনবাগান ফুটবল মাঠ। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে রাজভবনে যাওয়ার আগে জননন্দিত দুই বিশ্বনেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করলেন।
সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফর কলকাতায় দুদিনের জন্য। লক্ষ মুজিবের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে নিরন্তর রণিত হচ্ছে। ওই রণধ্বনিতে জনকের সংযমী, বলিষ্ঠ উচ্চারণ শোনা গেল তার সশরীর উপস্থিতিতে, ১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড গ্রাউন্ডের মহাসমাবেশে। দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন দীর্ঘাঙ্গি পুরুষ; যুক্তিময় আবেগে, জনতার উচ্ছ্বাসে একাত্ম হয়ে। পাশে উপস্থিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। সামনে কল্লোলিত জনসমুদ্র। সমুদ্র দেখে গেল নির্যাতিত জনতার দুই বিশ্ববন্ধুকে, দেখতে দেখতে প্রত্যাশিত মহামিলনে তরঙ্গায়িত হতে থাকল সেই মানুষের মহাসমুদ্র। সে এক অবিস্মরণীয় মহামুহূর্ত, যা মহৎ থেকে মহত্তর, আমাদের স্মৃতিসত্তায় জেগে থাকবে।
আমাদের সব যুক্তি ও আবেগের, দিগন্তস্পর্শী অভিযানের ভিত হয়ে টিকে থাকবে কলকাতা ব্রিগেড গ্রাউন্ডের ওই স্বপ্নের চিত্রকল্প। প্যারেড গ্রাউন্ডে জনতার ঢেউ সামলাতে না পেরে হাওড়াসহ কলকাতার ১০টি পার্কে লাউডস্পিকার লাগানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার ব্যাকুলতা ছিল অভাবনীয়। আবেগে সভা শেষ হওয়ার পরও প্যারেড গ্রাউন্ডে মানুষের ঢল থামেনি। একপাশে সুউচ্চ মঞ্চের একশ গজ দূরে খানিক নিচু ৫০ ফুট লম্বা মঞ্চ। মঞ্চে শতাধিক ছেলেমেয়ে গীতবিতানের দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। মেয়েরা সারি বেঁধে মঞ্চের ডানদিকে, ছেলেরা বাঁদিকে দাঁড়ানো। মেয়েদের পরনে গাঢ় সবুজ শাড়ি, লাল ব্লাউজ, বাংলাদেশের পতাকার রং।
আর ছেলেরা সাদা পাজামার সঙ্গে বাসন্তী পাঞ্জাবি ও মুজিব কোটের আদলে ধানি রঙের কোট, ভারতীয় পতাকার রং। সরলা দেবী চৌধুরাণী রচিত ‘জয় যুগ আলোকময়’ গান দিয়ে শুরু হয়। এরপর একে একে অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের গানগুলো পুরো ব্রিগেডকে আবেগে আপ্লুত করে।
শ্রীমতী গান্ধী ও ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন তার অগ্নিঝরা ভাষণ, ‘ভারতের মহান নেতা, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী, আমার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের জন্য আমি সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি, কৃতজ্ঞতার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি।’ ব্রিগেড ময়দানের জনতা বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা কণ্ঠ শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন।
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চ কাঁপিয়ে যখন বললেন, ‘যে জাতি মুক্তিপাগল, যে জাতি স্বাধীনতাকে ভালোবাসে, সে জাতিকে বন্দুক-কামান দিয়ে দাবাইয়া রাখা যায় না।’ লক্ষ লক্ষ জনতার উল্লাসধ্বনি, ব্রিগেড ময়দান তখন আবেগে ভাসছে।
ওই দিন কলকাতা ছিল বঙ্গবন্ধুময়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী এক কোটি মানুষকে ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত করেছিল। এই মানুষকে আশ্রয় দিয়ে, অন্ন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত সরকার। তাদের এই অবদান পরিশোধের সাধ্য নেই উল্লেখ করে প্রিয় রবীন্দ্রনাথের কবিতার আশ্রয়ে তিনি বলেন, ‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি/দেবার কিছু নাই/আছে শুধু ভালোবাসা/দিলাম আমি তাই।’
এরপর খুনি ইয়াহিয়ার হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে জেনেও নিক্সন সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেন। তিনি সমালোচনা করেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে ভারতকে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার। পাকিস্তানি বাজার রক্ষা করার জন্যই মার্কিন সরকার এরকম করেছে উল্লেখ করে গগনবিদারী করতালির মধ্যে বঙ্গবন্ধু আবারও পাঠ করেন, নাগিনীরা চারদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিতবাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস/বিদায় নেবার আগে তাই/ডাক দিয়ে যাই/দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে। উত্তাল ময়দানের উল্লসিত জনতাকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বাংলা তিতুমীরের বাংলা, আমার বাংলা সূর্য সেনের বাংলা, আমার বাংলা সুভাষ বসুর বাংলা, আমার বাংলা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা।
এ বাংলার মাটি পলি দিয়ে গড়া, বড় নরম মাটি। বর্ষায় মাটি বড় নরম হয়ে যায়। কিন্তু চৈত্রের কাঠফাটা রোদে মাটি এমন কঠিন শিলায় পরিণত হয়, তখন তা দিয়ে যে কোনো ষড়যন্ত্র আর যে কোনো ষড়যন্ত্রকারীর মাথা ভাঙা যায়। আমার দেশের মানুষও এই মাটির মতো। তারা শান্ত, তারা শান্তিপ্রিয়; কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে তারা কঠিন।’ ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তি পারবে না এই বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে। প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল জনসমুদ্রে আকাশ-কাঁপানো করতালির মাঝে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করতে সাম্রাজ্যবাদের খেলা চলতে দেওয়া হবে না।
লাখো জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বিশ্বের কোনো শক্তি এ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বিশ্বের ইতিহাসে আমাদের মতো এত বড় মূল্য দিয়ে আর কেউ স্বাধীনতা অর্জন করেনি। বহু কষ্টে অর্জিত এ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশে শেষ মানুষটিও প্রাণপণ সংগ্রাম করবে।
বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘আমরা ভারতবাসীরা এমন বিশেষ কিছুই করিনি যাতে করে কোনো প্রশংসার দাবি করতে পারি। আমরা শুধু সুষ্ঠুভাবে আমাদের কর্তব্য সম্পন্ন করতে পেরেছি। গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আমরা। তার জন্যই যুদ্ধ করেছি। এ দুই দেশের আদর্শ এক, অটুট থাকবে দুই দেশের মৈত্রী, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বন্ধুত্ব আর সহযোগিতা।’ একটি দেশের একটি শহর পড়শি দেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে কতটা ত্যাগ করতে পারে-১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কলকাতা তার উজ্জ্বল নিদর্শন রেখেছে। এসবের আদ্যোপান্ত বঙ্গবন্ধু জানতেন। তাই ১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক প্যারেড গ্রাউন্ডে আবেগে উদ্বেলিত ছিলেন। এ তল্লাটের আবেগি জনতাও তাকে পেয়ে আনন্দে ভাসছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর এই কলকাতা সফরকালেই রাজভবনে মুজিব-ইন্দিরার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের উন্নয়ন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন এবং ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হয়। স্থির হয়, ১৭ মার্চ ১৯৭২ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলাদেশে যাবেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চের আগেই ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। শ্রীমতী গান্ধী কথা রেখেছেন। তিনি ১২ মার্চ ১৯৭২-এ ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ১৭ মার্চ ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে স্বাধীন বাংলাদেশ সফর করেন।
ড. মো. মোফাকখারুল ইকবাল : প্রথম সচিব (প্রেস), বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন, কলকাতা
Leave a Reply