কোনো রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা পূরণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রক্ষা, জাতীয় নীতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নিজের অর্থনীতি বিকাশের প্রয়োজনে তার বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য পায় বেশি। তাই জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ তার বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করে আসছে। চলতি মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে।
১৯৭১-২০২১ সময়সীমায় বাংলাদেশে একাধিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল, আর যখন দেশটির ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে, তখনও আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায়। দীর্ঘ ৫০ বছরের সময়সীমায় বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় থাকলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে পার্থক্য আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু মূল ইস্যুতে তাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রটির জন্ম, সেই নতুন রাষ্ট্রটির পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সত্তরের দশকের শুরুতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় একদিকে গড়ে উঠেছিল ভারত-সোভিয়েত রাজনৈতিক অক্ষ, অন্যদিকে গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র-চীন অক্ষ।
এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি রচনা ও পরিচালনা করেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব দেশ সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল, তাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন। ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। যদিও এটা সত্য, তার শাসনামলের শেষের দিকে তিনি চীন ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ারও একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তার বৈদেশিক নীতির মূল ভিত্তি হবে ‘শান্তি’ এবং বাংলাদেশ হবে ‘এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’। তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে কোনো বৃহৎ শক্তির প্রভাব বলয়ে না রেখে নিরপেক্ষভাবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তাই বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে জোটনিরপেক্ষতা এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদ বিরোধিতা প্রাধান্য পেয়েছিল।
ওই সময় বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেছিল। সুতরাং ওই আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ ওই সময় আন্তর্জাতিক আসরে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ট্রেডিশনাল মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। এ কারণে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ গড়ার প্রয়োজন ছিল।
বঙ্গবন্ধু দু-দুবার মস্কো সফর করেছিলেন-প্রথমবার ১৯৭২ সালের মার্চে, আর দ্বিতীয়বার ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে বেসরকারিভাবে। একই সঙ্গে তিনি দু-দুবার ভারত সফর করেন-প্রথমবার ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, দ্বিতীয়বার ১৯৭৪ সালের মে মাসে। স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফর (১৯৭২ সালের মার্চে) ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু তার ৪৩ মাসের শাসনামলে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এগুলো ছিল-এক. তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ কারণে ১৯৭৫ সালের মে মাসে রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সারকে চীনে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল মে মাসে (১৯৭৫) ক্যান্টন বাণিজ্যমেলায় অংশ নিয়েছিল। দুই. ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বাংলাদেশ আরবদের পক্ষ সমর্থন করেছিল এবং যুদ্ধে একটি চিকিৎসক প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল।
ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থনের যে ধারা বাংলাদেশ শুরু করেছিল, তা আজও অব্যাহত রয়েছে। তিন. বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা ছিল যুগোপযোগী এবং তা মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করেছিল। চার. মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিল। এখানে প্রাধান্য পেয়েছিল জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান প্রণীত বৈদেশিক নীতি চীন, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা বলে লক্ষ করা যায়। সৌদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি আসে প্রথমবারের মতো। জিয়া চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে ওই সময়। ভারত ফারাক্কায় একতরফাভাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নেয়।
ওই সময় বাংলাদেশ দুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন করে (১৯৭৬ সালের মে মাসে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন এবং ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে ন্যাম-এর কলম্বো সম্মেলন)। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জিয়ার সময় থেকেই বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবিমান সরবরাহ নিশ্চিত করে।
এর ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। জেরুজালেম ও প্যালেস্টাইন সমস্যা সমাধানের ভিত্তি হিসাবে ‘আল-কুদ্স’ কমিটিতেও বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ ওই সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে (৩০ মে ১৯৮১) জিয়ার মৃত্যু, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ (মার্চ, ১৯৮২), ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার সরকারের পতন এবং ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সরকার গঠন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দুই ব্যক্তি সরকার পরিচালনা করলেও কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারব।
এক. চীনের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮১তম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হয়; দুই. এরশাদ চতুর্থবারের মতো চীন সফর করেন। ১৯৮৭ সালে দেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধলে তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন চীন সফরে গিয়েছিলেন দেশটির সাহায্য নিশ্চিত করতে; তিন. ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে; চার. ১৯৮৩ সালে ঢাকায় নিযুক্ত ১৪ জন সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে; পাঁচ. ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি।
বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করার পর (১৯৯১) তার বৈদেশিক নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনটি মূলনীতির কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন। এক. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করা, দুই. মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি, তিন. দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসাবে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের ২৫ মে। তিনি ভারতেও গিয়েছিলেন ২৪ মে। তবে তা রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না।
রাজীব গান্ধীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। এরপর তিনি চীনে যান ১৮ জুন। যুক্তরাষ্ট্রে যান ১৯৯২ সালের মার্চে। সরকারিভাবে ভারত সফর করেন ২৬ মে। বেগম জিয়ার প্রথম সরকারের সময় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নত হয়নি। ভারত ওই সময় গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে অন্য তিনটি বিষয় সংযুক্ত করে। এগুলো হচ্ছে-এক. পানি সমস্যার সমাধানে একটি সংযোগ খাল, দুই. বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা, তিন. বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি।
বেগম জিয়ার শাসনামলে ভারত কর্তৃক ‘অপারেশন পুশব্যাক’ নামে বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার একাধিক অপতৎপরতা লক্ষ করা যায়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ভারতের বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনায় নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে মন্তব্য করে তা ছিল দুঃখজনক (‘ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ’, ‘মৌলবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা’, ‘বাংলাদেশ সরকারের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের উপর মনোযোগ সহকারে নজর রাখা হবে’- Daily Star, 2 January 1993)।
বেগম জিয়ার সময়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন এবং গার্মেন্টসে শিশুশ্রম সম্পর্কিত ‘হারকিন বিল’ নিয়ে দুদেশের মাঝে সম্পর্কে কিছুটা চির ধরে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিল রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না। ১৯৯৩ সালের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলিতে পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের নেতিবাচক মন্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম জিয়া আবার সরকার গঠন করেছিলেন। তার দ্বিতীয় মেয়াদে চীন ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়।
২০০১ সালে চীন তার ইউনান রাজ্য, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব করে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। তার আমলে বাংলাদেশ আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্যপদ পেয়েছিল।
২০০২ সালের ডিসেম্বরে সাবেক থাই প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার বাংলাদেশ সফরে এসে বেগম জিয়াকে একই বিমানে করে থাইল্যান্ডের চিয়াংমাই নিয়ে যাওয়া ছিল সমসাময়িক কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। বেগম জিয়ার শাসনামলেই সিঙ্গাপুর এশিয়া-মিডল ইস্ট ডায়লগ-৮ (আমেড-৮)-এর প্রস্তাব করেছিল। এটা ছিল সন্ত্রাসবিরোধী একটি জোট। যদিও আমেড-৮-এর খবর তেমন আর পাওয়া যায় না। বেগম জিয়া ক্ষমতা ছাড়ার আগে ভারত সফরে গেলেও দুদেশের বিরাজমান সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান করতে পারেননি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করে। পরবর্তীকালে ৯ম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন। এখনও তিনি ক্ষমতায়। তার প্রথম সরকারের সময় (১৯৯৬-২০০১) কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। এক. সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা, দুই. চীনকে গুরুত্ব দেওয়া, তিন. ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ, চার. আঞ্চলিক জোটের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ, পাঁচ. যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বৃহৎ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকতা রক্ষা করা।
শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ভারত সফর করেন এবং ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ৩০ বছর মেয়াদি একটি পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলোকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের কথা শোনা যায়। ১৯৯৭ সালে সরকার জনসংহতি সমিতির সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ফলে ভারতে আশ্রয় নেওয়া চাকমা শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে আসে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও চাকমাদের বাংলাদেশে ফিরে আসা ছিল উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছেন। বিশেষ করে ভারতকে ট্রানজিট অথবা ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়া, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরকে ভারতীয় পণ্য রপ্তানিতে ব্যবহার করতে দেওয়া এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তিনি একাধিকবার ভারত সফর করেন। তবে তার আমলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমার ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। তার শাসনামলে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়াও ছিল দুঃখজনক। যদিও জানা যায় মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তি হয়নি।
তার শাসনামলে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শেখ হাসিনাও চীন সফর করেন। ভারত ও চীনের প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি ‘ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জঙ্গি দমনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ না দিলেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজমে’ যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন অবধি যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত সোফা ও আকসা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মার্কিন প্রশাসনের কাছে।
বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে একটি ছোট দেশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান, তার ভূমিকা, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যে কোনো উত্তেজনা, চীনের প্রভাব ও সেই প্রভাবকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের সম্ভাব্য ভূমিকা এবং স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান আগামীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply