জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি সম্পর্কে বাঙালি ও অবাঙলি প্রায় সবাই অবগত। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও কালজয়ী ভাষণটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, চলছে গবেষণাও।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণটি বেশি জনপ্রিয় হলেও বঙ্গবন্ধুর অন্য ভাষণগুলোর প্রতিও মানুষের আগ্রহ রয়েছে। ইউটিউব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নানা গবেষণা গ্রন্থে ভাষণগুলো আদরণীয় হয়ে উঠছে। কোনো কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কালজয়ী ভাষণগুলো আপলোড করে অর্থও কামাচ্ছে দেদার। যে যার মতো করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা এবং এই ভাষণ ব্যবহার করে অর্থ রোজগার করলেও এতদিন বঙ্গবন্ধু পরিবার থেকে কেউ আপত্তি জানায়নি।
তবে পশ্চিমবঙ্গের ইনরেকো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৭ মার্চের ভাষণ আপলোড করে নিজস্ব সম্পত্তি দাবি করায় প্রতিবাদের পাশাপাশি সতর্ক হয়েছে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। ইতোমধ্যে ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর সব ভাষণ কপিরাইট অফিসে রেজিস্ট্রেশন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণগুলোর কপিরাইট করার বিষয়ে কাজ করছি। আমাদের কপিরাইট অফিস এ বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। আমরা জাতির পিতার ভাষণগুলোর কপিরাইট করে ঠিকভাবে সংরক্ষণ করব, যাতে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর ও বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত মো. নজরুল ইসলাম খান (এনআই খান) আমাদের সময়কে বলেন, ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের ৭ মার্চের ভাষণের মালিকানা দাবির বিষয়টি আমাদের জানা। আমরা এর প্রতিবাদ করেছি। পরে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তিনি বলেন, লিজেন্ডারি ভাষণটি এতদিন সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।
অনেকে নিজেদের প্রয়োজনে ভাষণটির অংশবিশেষ ব্যবহার করে। তবে শুধু ৭ মার্চের ভাষণই নয়, আমরা বঙ্গবন্ধুর সব ভাষণের কপিরাইট করার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, এখনই মন্তব্য করার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। অগ্রগতি হলে আমরা গণমাধ্যমকে এ বিষয়টি জানাব।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে সচিব মো. বদরুল আরেফিন বলেন, আমরা ৭ মার্চের ভাষণের কপিরাইট পাওয়ার চিঠিটি ইতোমধ্যে হাতে পেয়েছি। এভাবেই পর্যায়ক্রমে অন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষণগুলোকেও কপিরাইটের আওতায় আনা হবে।
বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, আমরা মনে করি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কপিরাইট আরও আগে হওয়া দরকার ছিল। ভাষণটির স্বত্বাধিকারী তার পরিবার বা পরিবারের অনুমতিতে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট হতে পারে। এ নিয়ে অনেকবার বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টে যুক্তদের সঙ্গে কথাও বলেছি। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আবেদন পাইনি। তিনি আরও বলেন, কপিরাইট করা না থাকলে ভাষণের ভুল উপস্থাপনের জন্যও কপিরাইট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
এ বিষয়ে কবি ও কপিরাইট বিশেষজ্ঞ মনজরুর রহমানের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, মেধাভিত্তিক সম্পদের ক্ষেত্রে কপিরাইট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ চাইলে করতেও পারেন, না-ও পারেন। কপিরাইট না করলেই যে আইনের সহায়তা পাওয়া যাবে না, তা নয়। আর বঙ্গবন্ধুর বিষয়টি তো আরও আলাদা। কপিরাইট অফিসে রেজিস্ট্রেশন না করেও তো ভাষণটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এর পরও কি কেউ এর মালিকানা দাবি করতে পারবে?
জানা গেছে, তৎকালীন পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র করপোরেশনের চেয়ারম্যান এএইচএম সালাহউদ্দিনসহ বেশ ক’জন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ওই ভাষণের ভিডিও রেকর্ড করেন। তবে ভাষণটির ভিডিওধারণের ক্ষেত্রে অভিনেতা আবুল খায়েরের নাম বেশি আসে। একই সঙ্গে তৎকালীন ফরিদপুর অঞ্চল বর্তমান গোপালগঞ্জের এমএনএ এম আবুল খায়ের তার ঢাকা রেকর্ড প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ভাষণ মঞ্চের নিচে বসে গোপনীয়তার সঙ্গে অডিও রেকর্ড করেন।
এম আবুল খায়েরের সন্তান প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, আমার বাবা মঞ্চের নিচে লুকিয়ে ওই ভাষণের অডিও-ভিডিও ধারণ করেছিলেন। বাবার একটি রেকর্ড কোম্পানি ছিল ‘ঢাকা রেকর্ড’ নামে। ফলে তিনি অডিও রেকর্ডের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে বাবা যখন ভারতে যান তখন একটি রেকর্ড সঙ্গে করে নিয়ে যান। সেখান থেকে বিশ্বখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি এইচএমভির উদ্যোগে এ ভাষণের তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এ ধারণকৃত অডিও-ভিডিও তাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল।
Leave a Reply