কল্পকাহিনীকেও হার মানিয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জালিয়াতি। নাম-রেজিস্ট্রেশন রিপ্লেসমেন্ট করে যে কাউকেই দেয়া হয় ছাত্রত্ব। আবার পরীক্ষা না দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে ভালো রেজাল্ট। এমনি অনেক অবাস্তব ঘটনা ঘটছে এখানে। বিগত তিন বছরের বেশি সময় ধরেই চলছে এই তুঘলগি কাণ্ড। আর এসব অনিয়মের মূল হোতা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্টের বিরুদ্বে অভিযোগ থাকলেও তিনি এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যদিও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান বলছেন অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ার আগে আইনানুগভাবেই আমাদের কিছু করার নেই। তবে অভিযোগের তদন্ত সুষ্ঠুভাবে চলছে বলেও জানান বোর্ড চেয়ারম্যান।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিন থেকেই নানাভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এর সাথে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও জড়িত। এই সিন্ডিকেটটি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হলেও টাকার বিনিময়ে একজনকে ছাত্র বানিয়ে দিচ্ছে। আবার পরীক্ষায় অংশ না নিলেও পাস করিয়ে দিচ্ছে যে কাউকে। বিশাল অঙ্কের টাকা গুনলেই এভাবে পাস ও সনদও মিলছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালের এসএসসি ভোকেশনালে ছাত্রভর্তি ও ফলাফলে এমন জাল-জালিয়াতিরও সত্যতা মিলেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ভয়াবহ এই জালিয়াতি ও দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তারা এখনো চাকরিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধতন কিছু কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি এমন অভিযোগে বোর্ডের দু’জন কম্পিউটার অপারেটরকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেই সাথে শিক্ষার্থীদের সাথে অনিয়ম করার অভিযোগে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনও বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু মূল হোতা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট সামসুল আলম ও প্রোগ্রামার ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে এখনো দৃশ্যমান কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার এসব অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে দুদকে অভিযোগ দাখিলের পর দুর্নীতি দমন কমিশন বিভাগের সহকারী পরিচালক নূরজাহান পারভিন স্বাক্ষরিত একটি আদেশ দেয়া হয়। আদেশে বলা হয়, ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমের নবম শ্রেণীর ভর্তিকৃত বা রেজিস্ট্রেশনকৃত শিক্ষার্থীর তালিকার কপি ও ২০১৭ সালের নবম শ্রেণী সমাপনী পরীক্ষা এবং ২০১৯ সালের দশম শ্রেণী এসএসসি পরীক্ষা এর প্রবেশপত্র কপি, অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, সনদপত্র, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রমের ভর্তিকৃত বা রেজিস্ট্রেশনকৃত শিক্ষার্থীর তালিকার কপি, ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম পর্বের পর্ব সমাপনী পরীক্ষা পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্র কপি, অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট এবং সনদপত্র, পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হাজিরা সিট দাখিল করার জন্য বোর্ড চেয়ারম্যান ড. মোরাদ হোসেন মোল্লার কাছে একটি বার্তা অনুলিপি প্রেরণ করেন। এসব প্রতিষ্ঠানে কোডগুলো হলোÑ এসএসসি ভোক : ৫৩০৯৫, ৫২০৮৭, ৫২০৬৯, ৫৯০৫৬, ৫৯০৯৭, ৫৩০৮৮, ৫২০৮২, ১২০১৬, ৫৯০৩৮, ৫২১১২, ৫৪১১৩ ও ৪৭০১৮। ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠানে কোডগুলো হলো- ১৬০৫৭, ২৪১৬০, ৩১০৩৬, ৪৮০৩৫, ৫০০৯৪, ৫০০৯৭, ৫০১১৪ ও ৫৩০৮২।
অন্য দিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে ভর্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই অন্য শিক্ষার্থীদের নাম রেজিস্ট্রেশন রিপ্লেসমেন্ট দেখিয়ে ফলাফল বিক্রির অভিযোগও রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি (বিএম) প্রথম বর্ষ পরীক্ষা অংশগ্রহণ করেন এবং ২০২০ সালে দ্বিতীয় বর্ষ পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপ করেন। বিটিইবির ওয়েবসাইটে ফরম ফিলাপের লিস্টে তাদের নামও আছে কিন্তু পরীক্ষার্থীরা প্রবেশপত্র পায়নি এমনকি তারা প্রম বর্ষের অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টও পায়নি।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট সামসুল আলমের সাথে তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে গত দুই দিনে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সর্বশেষ গতকাল বিকেলে তাকে খুদে বার্তা দিয়ে কথা বলতে (ফোন রিসিভ করতে) অনুরোধ জানানো হয়। পরে তিনিও খুদে বার্তায় জানতে চান কোন বিষয়ে কথা বলতে চাওয়া হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য চাইলে তিনি অভিযোগের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। শুধু ফিরতি বার্তায় তিনি লিখে জানান, আমাদের দেশের কল্যাণের জন্য কিংবা মানুষ হিসেবে আমাদেরকে সত্য খুঁজে বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। দয়া করে হলুদ সাংবাদিকতা করবেন না। এটিই আমার অনুরোধ।
গতকাল বুধবার বিকেলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো: মোরাদ হোসেন মোল্লার সাথে কথা হলে তিনি জানান, উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। অভিযোগগুলো তদন্ত করতে ছয় সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তারাই এটি দেখছে। অভিযুক্তরা এখনো পদে থেকে কিভাবে কাজ করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তদন্ত চলছে, তারাও কাজ করছে। কারো বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কিছুই করার নেই।
Leave a Reply