দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়ে এ জনপদের মানুষ গত কয়েক শতাব্দী ধরেই নিষ্পেষিত হচ্ছে। এক দিকে ছিঁচকে ঠগ-জোচ্চোর; ভিলেজ পলিটিক্স, সন্ত্রাস, প্রায় একদলীয় দুঃশাসনের টিকল-ডাউন ইফেক্ট সর্বত্র : নিত্যপণ্যের চড়া দাম, মহামারী এবং মহামারী থেকে জন্ম নেয়া ডিপ্রেশন; অন্য দিকে ধর্ষণের মহোৎসব এবং নৈরাজ্যকর অবস্থায় জনজীবনে ত্রাহি মধুসূদন হাল; মহামারীজনিত বেকারত্ব এবং মজুরি সঙ্কোচন; অনিয়মিত মাইনে আর সেই সাথে রাষ্ট্রীয় সেবা খাত ও বেসরকারি খাতের মোবাইল ফোন সেবার নিত্যনতুন রেট বৃদ্ধি, গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের জীবন আজ সত্যিই ওষ্ঠাগত। এই দুঃসময়ে আর এক বিশাল শোষণ হাতিয়ারে পর্যুদস্ত হচ্ছে সমিতি ও সমবায় করা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নারী সমাজ। গ্রামে এর দৌরাত্ম্য আরো বেশি।
গ্রামে এনজিও ও ব্যাংকগুলো মানুষের উপকারও করছে; জ্বালিয়েও মারছে। তাদের হাল ও বকেয়া কিস্তির টাকা পরিশোধ করা এখন গ্রামীণ মানুষের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ নিয়েও আগেকার বেতন হাঁকছে। সরকার যদিও এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। তবে তারা ম্যাগাজিন ভাতা বাদ দিয়ে আর সব খাতে ফি ঠিকই আদায় করছে।
শহরেই হোক আর গ্রামেই হোক, যারা দুটো পয়সার জন্য সামাজিক সঞ্চয় বা সঙ্ঘের সদস্য হয়ে বড় কোনো উদ্যোগে শরিক, তাদের ব্যবসা বা উদ্যোগের খরিদদার বা উৎপাদন কমে গেলেও বিনিয়োগের কিস্তি ঠিকই গুনতে হচ্ছে। যে এনজিও গ্রামীণ নারীদের গরু পালা বা পোলট্রি খামারে ঋণ দিয়েছে, তাদের সেই অর্থায়নে খামারে গরু, ছাগল, উঠানে বা খামারে মুরগি ঠিকই আছে; তবে ক্রেতা কমে গেছে। বিক্রি আগের মতো থাকলে কিস্তির টাকা দিতে তাদের বেগ পেতে হতো না। এখন তো চাহিদা কম; তাই মূল্যও কম। করোনা মহামারীতে সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রামীণ উদ্যোক্তারা। তাদের সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে; কিস্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে?
সমিতি ও এনজিওগুলোর সুদের হার বেশ চড়া। যারা ব্যক্তিগত মহাজনী দাদন দেন, তাদের সুদহার সমিতি বা এনজিওগুলোর প্রায় দ্বিগুণ। মহাজনী ব্যবস্থা উঠে গেলেও এই মনোবৃত্তির দাদনদার বা সুদে টাকা খাটানোর খাসলতটা অনেকের মধ্যে রয়ে গেছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের সুদখোর কুসিদজীবীদের মধ্যে। অনেক চতুর ওই শ্রেণীর মানুষ, তাদের স্ত্রীরা বিশেষ করে, দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারগুলোর অভাবের সুযোগে নগদ অর্থ দাদন দিয়ে থাকেন। তাদের ঋণ আদায় রীতিমতো নিষ্ঠুর ও নির্দয় প্রকৃতির। তারা এলাকার হোমরা চোমরা বা লাঠিয়াল পালেন। কিস্তির টাকা যোগাতে না পারলে ঋণগ্রহীতার খবর আছে। এগুলো দেখার জন্য রাষ্ট্রের কোনো ব্যবস্থাই নেই। এ রাষ্ট্র নিজেই তো নির্দয় ও খাজনা আদায়ী অবিবেচক প্রকৃতির।
চোরে চোরে যেমন মাসতুতো ভাই হয়, সুদে সুদে তেমনি জেঠাতো ভাই সম্পর্ক। দু’জনাই কুসিদ। খাজনা আদায়ে সরকার এবং কিস্তি আদায়ে সমিতি, এনজিও বা ব্যাংক। ব্যাংকের নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতা ও কাগজপত্রের ঝুট ঝামেলার কারণেই মানুষ সমিতি বা স্থানীয় এনজিওগুলোর কাছে ঋণ নেন। এনজিওর নানা প্রকারের শর্ত ও নিয়ম-শৃঙ্খলার কারণেই মানুষ বাধ্য হয় ব্যক্তিগত সুদখোর দাদন দাতাদের কাছে যেতে। ঋণ নিয়েই মানুষ চড়া সুদের ফাঁদে আটকা পড়ে। কোনো উপায়ে সুদ যোগাতে পারলেও আসল থেকে যায় বকেয়া। তার সাথে আবার যোগ হয় মূলের ওপর সুদ। সেই সুদ আর হাল সুদ মিলে আসলকে ছাপিয়ে যায় সুদের সুদ, তার সুদ, তার সুদ। এভাবে সুদের ফের তাঁতের পানা ও টানার মতো বজ্রগুণে বাড়তে থাকে। ঋণের এই ফাঁদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রকে অনিবার্যতই এগিয়ে আসতে হবে।
রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে মানুষে মানুষে শোষণের কাঠামোগত অনিয়ম ও শোষণযাঁতা অকার্যকর করে মানুষকে বাঁচানো। হিটলারের ইহুদিবিরোধী নীতির মূলে ছিল সুদের এই যাঁতাকল থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানো। তবে তার অমানবিক সমাধান সত্যিকারের সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়। জার্মানির শোষণ থামানোর ক্রিয়া ফিলিস্তিনিদের ঘরছাড়া, দেশছাড়া করে। উদোর পিণ্ডি চাপে বুধোর ঘাড়ে। ব্রিটিশ রেফারি বেলফার ওই অবিচারের পুরোহিত ছিলেন। তার রায়েই আরবরা দেশ হারান। সুদখোর মাড়োয়ারিদের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণেই বাংলার স্বাধীনতা হারান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদদৌল্লাহ। সুদখোরদের বিরুদ্ধে সূচিত আরব সংগ্রামকেই এগিয়ে নেন লিবিয়ার স্বাধীনতার বীর সংগ্রামী ওমর আল মুখতার।
পৃথিবীতে যত অশান্তি হানাহানি যুদ্ধ, গণহত্যা, নিপীড়ন ও উৎপাটন, দেখবেন সব অনিষ্টের মূলেই রয়েছে শোষণ এবং সুদি চক্রের কারসাজি। মানুষের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে আগে সুদখোর মহাজনরা ফুলে ফেঁপে উঠত; এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে সমিতি চক্র, এনজিও ও ব্যাংকগুলো। ব্যতিক্রম সব খানেই আছে। তবে কাঠামোগত শোষণের অঙ্কটা সবখানে একই সমীকরণে কাজ করে। কার্ল মার্কস এটাই চিহ্নিত করেছিলেন তার দার্শনিক গবেষণায় (ডাশ ক্যাপিটাল)। এই চক্রের গোঁড়ায় স্পর্শ করেও মার্কেন্টাইল পুঁজির কাছে হার মানেন অ্যাডাম স্মিথ। জমির খাজনা তত্ত্বে সংস্কার সুপারিশ করেও সমাধান সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হন রিকার্ডো। হতেই হবে। পুঁজিবাদ তো দাঁড়িয়েই আছে শোষণের ভিত্তির ওপর। এই ভিত্তিটা ভাঙবে কে? সেই ঈমানের বল ক’জনারই বা আছে। লোভের ঊর্ধ্বে উঠার মতো মানসিক শক্তি ক’জনাই বা রাখেন?
কী সাংঘাতিক জঘন্য এই সুদ! কী ভীষণ এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। সুদ ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট করে, সুদে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, মন্দা দেখা দেয়। কারণ ঋণ পাহাড়সম স্তূপ হয়ে পড়ে, সুদের কারবারে সুদখোর ব্যবসার ঝুঁকির নেয় না, লোকসানের ঝুঁকিও নেয় না। সুদে একচেটিয়া কারবার (মনোপলি) সৃষ্টি হয়। ধনী আরো ধনী এবং গরিব আরো গরিব হতে থাকে। ২০০৮ এবং ২০০৯-এ বিশ্বজুড়ে আর্থিক খাতে সঙ্কট দেখা দেয়ায় রোমের দৈনিক ‘ভ্যাটিক্যান’ পত্রিকা বিখ্যাত এল ও রোমানোকে উদ্ধৃত করে লিখে যে, বিশ্বের এ ধরনের আর্থিক সঙ্কটের ঝুঁকি এড়াতে ইসলামী অর্থব্যবস্থা থেকে পাশ্চাত্য দেশগুলোর শিক্ষা নেয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে ভ্যাটিকানের সর্বোচ্চ ক্যাথোলিক গির্জা কর্তৃপক্ষ মন্তব্য করেন, “The ethical principles on which Islamic finance is based may bring banks closer to their clients and to the true spirit which should mark every finacial service.”
সুদের মূলে থাকে লোভ; ব্যবসার মূলে থাকে লাভ। ব্যবসা তাই বৈধ এবং কল্যাণকর। ঠিক এর বিপরীতটাই হলো সুদের খাসলত। কবি গেঁটের ‘ফাউস্ট’ এবং শেক্সপিয়রের ‘টিমন অব এথেন্স’ উদ্ধৃতি দিয়ে তাই কার্ল মার্কস লিখেছিলেন- অর্থই যত অনর্থের মূল। অর্থ জাতিগুলোর মধ্যে বিবাদ তৈরি করে। ইসলামের মতো খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্বেও লোভের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছে। এই লোভই হলো সুদের মূল ভিত্তি। দাঁন্তে তার ‘ডিভাইন কমেডি’তে মানুষের লোভ কিভাবে বিধাতার ক্রোধের জন্ম দেয় তা তুলে ধরেছেন। শেক্সপিয়রের ‘দি মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এ সুদখোর শাইলকের চরিত্র দিয়ে সুদের অমানবিক নির্মমতার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। চার্লস ডিকেন্স তার ‘A Christian’s Story’ উপন্যাসে এবং মলিয়ের তার ‘দ্য মাইজার’ উপন্যাসে এক সুদখোর চরিত্রের পৈশাচিক শঠতার চিত্র তুলে ধরেছেন। দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এ প্রবীণ সুদখোর দম্পতির চরিত্র এবং বৃদ্ধের খুনের পেছনে তার আর এক সুদখোর বন্ধুর চিত্র তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশে নানা রূপে, নানা বর্ণে সেই একই সুদের চক্র কাজ করছে। কখনো সমিতির নামে, কখনো সঞ্চয়ের ওছিলায়, কখনো ব্যক্তিগত দাদনের নামে চলছে এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক সুদের কারবার। কাঠামোগত রূপেও সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে এগুলোর মধ্যে আগেকার মহাজনী ঋণ ও সুদের যে নিষ্ঠুর যাঁতাকলে মানুষ পিষ্ট হচ্ছে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া অনেক ভয়াবহ। তাদের বাঁচাতে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।
Leave a Reply