‘চিনি মিঠা, মিষ্টি মিঠা/মিঠা দুধের সর। তাহার চাইতে অধিক মিঠারে/বউয়ের হাতের চড়’- নির্মলেন্দু চৌধুরীর লেখা খুবই জনপ্রিয় একটি গানের কথা এগুলো। বলাবাহুল্য, প্রয়াত এই সংগীত ব্যক্তিত্বের রসবোধ ছিল প্রবল। তবে বাংলাদেশের সরকারি চিনিকলগুলোর পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয়, তার এ গানের কথাকেও ছাড়িয়ে গেছেন মিলগুলোতে দায়িত্বশীল যারা আছেন, তারা। তাদের কাছে মিঠা ভোগ্যপণ্য চিনির চেয়েও বেশি মিঠা হয়ে গেছে দুর্নীতি। আখ কেনা থেকে শুরু করে চিনি উৎপাদন ও বিপণন পর্যন্ত পদে পদে দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি মেরামত ও কেনাকাটা, আখ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে চিনি না পাওয়া, চিনি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হওয়া, যথা সময়ে আখচাষির প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ না করা, দক্ষ জনবলের অভাব ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোতে বাড়ছে লোকসানের বোঝা। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহাড়সম ব্যাংক ঋণের সুদ, অপ্রয়োজনীয় জনবলের বেতনভাতা, যাচ্ছেতাই ব্যবস্থাপনাসহ আরও অনেক কারণ। সব মিলিয়ে দেশের চিনি উৎপাদন শিল্পের খাত এখন আছে লাইফ সাপোর্টে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এমনটাই মনে করছেন।
ইতোমধ্যেই রুগ্নশিল্পে পরিণত হয়েছে এ খাত। কলগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতনভাতা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। এ ছাড়া আখচাষিরা যথাসময়ে মিলগুলোতে তাদের ফসল বিক্রির টাকা না পাওয়ায় আখচাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। সার্বিক পরিস্থিতিতে সরকারি চিনিকলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত।
আখচাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক নেতারা বলছেন, চিনিশিল্পের প্রধান কাঁচামাল উৎপাদনকারী আখচাষিরা চুক্তিবদ্ধ হিসেবে ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণের অর্থ (সুদসহ ৯৯ শতাংশ প্রায়) এ পর্যন্ত ৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করলেও মিলগুলোর কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে ঋণের টাকা ব্যয় করেছেন। ফলে ব্যাংক ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা চিনি উৎপাদন খরচ ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা দেখিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করেছেন। অথচ চিনির উৎপাদন খরচ হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৭০-৮০ টাকা। বিদেশ থেকে বেশি দামে চিনি আমদানি করে অনেক কম দামে চিনি বিক্রি করায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। কেনাবেচায় দুর্নীতি, মাথাভারি প্রশাসন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় চিনিশিল্প দিন দিন লোকসানের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আখচাষের প্রয়োজনীয় উপকরণ সার, কীটনাশক সরবরাহ না করায় আখচাষ বন্ধ হয়ে গেছে। আখের অভাবে ভবিষ্যতে মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এমনও আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আখ উৎপাদন হয়েছে ৮২ হাজার ১৪০ টন। প্রতিকেজি আখ কিনতে হয়েছে ৫৯ টাকা ৪৯ পয়সা দরে। গড় হিসাবে কেজিপ্রতি আখ ও কাঁচামাল বাবদ খরচ হয়েছে ৬২ টাকা ৫১ পয়সা। কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাবদ ৪৭ টাকা ২৩ পয়সা, ব্যাংকের সুদ ৬৫ টাকা ৪৪ পয়সা ও অন্য খরচ ৫ টাকা ৭৩ পয়সা। এ হিসাবে এক কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয় ১৮০ টাকা ৯২ পয়সা। সুদের কারণে উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়।
এদিকে বিশ্বের অন্য দেশে প্রতিটন আখ থেকে ১২-১৪ কেজি চিনি উৎপাদিত হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টনপ্রতি চিনি উৎপাদিত হয় মাত্র ৫ দশমিক ৮৩ কেজি। তবে আগের চেয়ে সুগার বিটে চিনির পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়।
জানা গেছে, ব্রাজিলে প্রতিটনে ১২-১৪ কেজি চিনি পাওয়া যায়। ভারতে ১০-১২ কেজি, থাইল্যান্ডে ১০-১২ কেজি, মরিশাসে ১৩-১৪ কেজি, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটন আখে চিনি উৎপাদন হয় ১৬-১৮ কেজি। বাংলাদেশে আখ থেকে চিনির পরিমাণ কম উৎপাদিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আখের জাত ভালো না হওয়া, নতুন জাত উদ্ভাবন না হওয়া ও অকেজো পুরনো মেশিনে আখ মাড়াই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি ১৫টি মিলের মধ্যে কেরু অ্যান্ড কেরু কোম্পানি কেবল লাভে রয়েছে। এ ছাড়া বাকি ১৪টি চিনিকলে লোকসান হয়েছে ৯৩৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সুদ বাদে লোকসানের পরিমাণ ৪২৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
বিএসএফআইসির ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৫৬৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বকেয়া বেতন ও মজুরি, ওভারটাইম, গ্র্যাচুইটি, পিএফ, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীদের বকেয়া বিলসহ বিএসএফআইসির বকেয়া ৬৭৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
ট্রেড গ্যাপ ও ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে বিএসএফআইসির পাওনা রয়েছে ৪ হাজার ৪০২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ভারতসহ অন্য দেশের অনুসরণে আখ ক্রয়ে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদানে ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯-২০ মৌসুমে আখের জন্য ২৫ শতাংশ ভর্তুকি বাবদ ১২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা সরকারের কাছে পাওনা রয়েছে।
জানা গেছে, কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর, রংপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৮০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। তার মধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকল ৬১ কোটি, পাবনা ৭৪ কোটি, পঞ্চগড় ৪৭ কোটি, শ্যামপুর ৫৯ কোটি, রংপুর ৫৩ কোটি এবং সেতাবগঞ্জ ৮৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে।
রংপুর চিনিকলে প্রতিকেজি চিনি উৎপাদনে গত মৌসুমে খরচ হয়েছে ১৮৬ টাকা ২৪ পয়সা। এ চিনিকলের ১৫৮ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আছে। এর সুদ হিসাব করলে প্রতিকেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। সেই চিনি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৩ টাকা ৩৫ পয়সা কেজি দরে। পঞ্চগড় চিনিকলে গত মৌসুমে প্রতিকেজি চিনির উৎপাদন খরচ ছিল ৩০২ টাকা (সুদসহ)। একইভাবে প্রতিকেজি উৎপাদনে কুষ্টিয়ায় ২৭৩, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯ এবং পাবনায় ১৭৮ টাকা ব্যয় হয়েছে। উৎপাদিত চিনি বিক্রি হয়েছে ৫৩ থেকে ৫৭ টাকা কেজি দরে।
কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে চিনি উৎপাদন করেও বাজার কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না বিএসএফআইসি। প্রতিষ্ঠার সময় সরকারি চিনিকলগুলোর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ টন। সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে মাত্র ৮২ হাজার টন চিনি উৎপাদন করেছে মিলগুলো। দেশের বাজারে বছরে ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে করপোরেশন যে চিনি সরবরাহ করে, তা বাজার চাহিদার মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনিকলগুলো ব্রিটিশ আমলের। এসব কলে উৎপাদন ক্ষমতা কম। এ ছাড়া আখের সরবরাহ কম, উৎপাদন খরচ বেশি, বছরের অধিকাংশ সময় মিলগুলোর বন্ধ থাকা ইত্যাদি কারণে লোকসানে চলছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মতে, চিনিকলগুলোয় শুধু চিনি উৎপাদন করে লাভজনক করা যাবে না। চিনিকলের কর্মচারীদের বছরে মাত্র ৩ মাস কাজ থাকে। বাকি ৯ মাস অলস কাটান। আখ মাড়াই মৌসুম শেষ হলে চিনিকলগুলোয় অন্য পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। লোকসানের ভার সইতে না পেরে দেশের ৬টি চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ রাখার ঘোষণায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নানা শ্রেণির শ্রমিক। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করেন তারা।
কেজিপ্রতি ৭০-৮০ টাকা উৎপাদন খরচ কীভাবে হয় এমন প্রশ্নে সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সভাপতি মজাহারুল হক প্রধান আমাদের সময়কে বলেন, সুদ বাদ দিয়ে অন্য খরচসহ উৎপাদন খরচ ৭০-৮০ টাকা হয়। আমরা এভাবেই হিসাব করেছি। সুদের ঘানি আখচাষি ও শ্রমিকরা বহন করবে কেন? এ সুদের ঘানি চিনি উৎপাদনের সঙ্গেও কেন যাবে? তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কর্মকর্তারা খেয়ে ফেলছেন। এ ঋণের ঘানি মিল কেন টানবে। তিনি আরও বলেন, মূল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সরকারি চিনিকলগুলোর ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। কিন্তু বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে কথা বলে না। বছরের পর বছর দুর্নীতির ফলে এখন চিনিশিল্পের বর্তমান বেহাল হয়েছে।
মজাহারুল হক প্রধান বলেন, আমাদের উৎপাদিত চিনি স্বাস্থ্যসম্মত। এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একে সঠিকভাবে বাজারজাত করতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন চিনিকলের লোকসানের বিষয় সরকারকে একটি মহল ভুল বোঝাচ্ছে। তারা এ থেকে সুবিধা নিতে চাচ্ছে।
চিনিশিল্প করপোরেশন শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, আধুনিকতার নামে চিনিকল বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না। চিনিকল চালু রেখেই একে আধুনিক করতে হবে। পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হলে এসব কারখানার উৎপাদন ব্যয় কমবে। আখে চিনি আহরণের মাত্রাও বাড়বে। কেরু অ্যান্ড কোম্পানির মতো প্রতিটি চিনিকলেই ভিনেগারসহ অন্য পণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে।
জানতে চাইলে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা আমাদের সময়কে বলেন, মান্ধাতা আমলের চিনিকল হওয়ায় কোনো কোনো কলের যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে। যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। পাশাপাশি সুদের ঘানি তো আছেই। মিলগুলো লাভজনক করতে হলে মিলের সুদ ও ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চলতি মূলধনের জোগান, কৃষককে সময়মতো আখের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি চিনিসমৃদ্ধ আখের জাত উদ্ভাবন ও সংগ্রহ করা, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মিলে আখপ্রাপ্তি ৮-১০ শতাংশ রিকভারিতে চিনি উৎপাদন নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিদ্যমান শিল্পগুলোর আধুনিকায়ন, বহুমুখীকরণ ও নতুন আধুনিক চিনিকল স্থাপন, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও জনবল নিয়োগ এবং ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তরের পরামর্শ দেন বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাবেক ট্রাস্টি এম হাফিজউদ্দিন খান আমাদের সময়কে বলেন, চিনিশিল্প অনেক বছর ধরেই সমস্যায়। এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা দরকার। তিনি বলেন, মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেললে যেমন সমাধান হয় না, তেমনি লোকসানের কারণে চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়াটাও ঠিক হবে না।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা আমাদের সময়কে বলেন, বেসরকারি চিনিকলগুলো লাভজনক অবস্থায় থাকলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন লোকসান দেবে তা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলা যায়, পরিমিত লোকবল, দক্ষ জনশক্তি ও দুর্নীতি কমানো গেলে লোকসান অনেকটাই কমানো সম্ভব বলে মনে করি।
Leave a Reply