ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে কোভিড-১৯ টিকা পৌঁছানো থেকে বাংলাদেশ এখনো বহুদূরে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রতিমাসে যদি দুই কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা না থাকে, তা হলে কখনই সব মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে না। দ্রুত এ টিকা পেতে বাংলাদেশকে জোগানদাতাদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক বাড়াতে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তারা।
গত শনিবার স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন : বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?’ শীর্ষক এক অনলাইন সেমিনারে বক্তারা এমন মতামত দেন। কম্বোডিয়া থেকে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়া উদ্দিন হায়দারের পরিচালনায় এতে অংশ নেন আইইডিসিআরের ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন, বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান এবং আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের ট্রান্সন্যাশনাল রিসার্চ ম্যানেজার ড. আরমান রহমান।
সূচনা বক্তব্যে ড. আরমান বলেন, ভ্যাকসিনের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কতদিন থাকবে সেটি বলার সময় এখনো আসেনি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সেটি ৯ মাস থেকে এক বছর হবে। কোনো ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতদিন সেটি নিয়ে সব দেশই হিসাব কষছে। মডার্নার ভ্যাকসিন একটি সম্ভাব্য ভালো ভ্যাকসিন হতে পারে, যেটি ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
ড. মুশতাক জানান, একটি খসড়া করা হয়েছে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন এলে কারা সেটি আগে পাবেন। প্রথমেই থাকবেন সব স্তরের স্বাস্থ্যকর্মী, সংখ্যাটা ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৩৬১। এর পর বেসরকারি হাসপাতাল, এনজিও থেকে প্রায় সাত লাখ। এর পর যারা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে আসেন, যেমন বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিক্যাল স্টাফ- সংখ্যা দেড় লাখ। এর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই লাখ দশ হাজার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্য, যারা ফ্রন্টলাইনার- ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯। সশস্ত্র বাহিনী, র্যাব, বিজিবি ৩ লাখ ৯ হাজার ৭১৩। ডিসি, ইউএনওসহ আমলা ৫ হাজারের মতো। ফ্রন্টলাইনার সাংবাদিক ৫০ হাজারের মতো। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ৬৮ হাজার ২৯৮। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কর্মচারী ও অন্যান্য দেড় লাখের মতো। ইমাম, ধর্ম যাজক ইত্যাদি ৫ লাখ ৮৬ হাজার। দাফন-কাফনে যুক্ত ৭৫ হাজার? ওয়াসা, ডেসা, ফায়ার সার্ভিস, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কর্মী ৩ লাখ ৫০ হাজার। বিভিন্ন বন্দরের কর্মী দেড় লাখ। বিদেশ গমনেচ্ছু ১ লাখ ২০ হাজার।
জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সাড়ে তিন লাখ। ব্যাংকে চাকরিজীবী যারা সরাসরি ডেস্কে কাজ করেন ১ লাখ ৯৭ হাজার। রোগী যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ৫ লাখ ৭৫ হাজার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকর্মী ২৬ হাজার ২৭১ এবং অন্যান্য। এই ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন মানুষ দেশে ৩ শতাংশ ভ্যাকসিন এলে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবেন দুই ডোজ করে? এর পর ৬০ বছরের বেশি বয়সী লোক ১২ লাখ ৯৬ হাজার, শতাংশ ৭ ভ্যাকসিন এলে সেটি পাবেন।
তিনি আরও বলেন, আইইডিসিআর সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সারাবছরই অজানা মহামারী আসবে এমন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। যখন করোনা মারাত্মক রূপ নিল তখন ডিজি হেলথ এদের শক্তিশালী না করে ভাড়া করা লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ফলে জেকেজি, শাহেদদের মতো প্রতারকরা ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের কাজ যেহেতু ইপিআই করে; সুতরাং তাদের এ দায়িত্বে না রেখে ভাড়া করা লোকদের দিলে সমস্যা বাড়বে।
অধ্যাপক ডা. সায়েদুর বলেন, দেশের সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর যদি জনগণের আস্থা না থাকে, তা হলে মহামারী মোকাবিলা দূরে থাক, সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াই সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে দেশে আস্থার সংকট রয়েছে। এটি মহামারী কেন্দ্রিক নয় আগেও ছিল, করোনাকালে স্পষ্ট হয়েছে মাত্র। প্রতিমাসে ২৫ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া গেলে বছরে ৩ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। ১৩ কোটি মানুষকে দিতে হলে প্রয়োজন হবে সাড়ে চার বছর। আর ভ্যাকসিনগুলোর গড় কার্যকারিতা ধরা হচ্ছে ৯ মাস থেকে এক বছর। এভাবে হলে তো সারাজীবনেও সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।
ড. মুশতাক বলেন, সমস্যা সমাধানে জনবল এবং সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। করোনা মোকাবিলাকে বিশ্বযুদ্ধ বা যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা মোকাবিলার সঙ্গে তুলনা করে অধ্যাপক ডা. সায়েদুর বলেন, কানাডা, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি এখন আর শুধু স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক জেনারেলরা ভ্যাকসিনের দায়িত্বে আছেন। বাংলাদেশকেও সেভাবে এগোতে হবে।
Leave a Reply