ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকবেন আরও দুই মাস। ২০ জানুয়ারি জো বাইডেনের শপথগ্রহণের দিন। ওইদিন পর্যন্ত তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-ইলেকট বা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। পুরো প্রেসিডেন্ট নন।
এটাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নিয়মনীতি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে, এ নিয়মরীতি মেনে ট্রাম্প তার পরাজয় মানছেন না। তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না।
তিনি গোঁ ধরেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, তাতে ডেমোক্র্যাটরা কারচুপি করেছে। কিন্তু এ কারচুপির কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি তিনি। যারা এ ব্যাপারে তদন্ত করেছেন, তারা বলছেন-এ নির্বাচন সবচেয়ে সুষ্ঠু হয়েছে। কোনো কারচুপি হয়নি। আদালতে ট্রাম্প-শিবির যে মামলা করেছিল, আদালত তা সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে দিয়েছেন। জজ সাহেবরা বিরক্ত হয়ে মামলা ডিসমিস করেছেন।
তবু ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুঁশ নেই, লজ্জা নেই। তিনি ক্রমাগত বলে চলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তিনিই প্রেসিডেন্ট হতেন। ট্রাম্পের গোঁ অনেকটা বাংলাদেশের বিএনপির মতো। ১৯৯৬ সাল থেকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর যে কটিতে তারা হেরেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পের মতো চিৎকার শুরু করেছেন-নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এ চিৎকার থেকে এখনও তারা বিরত হননি। কোনোদিন হবেন মনে হয় না।
আমেরিকার কথায় যাই। এখন কথা, ট্রাম্প যদি এরকম অন্যায় গোঁ ধরে বসে থাকেন তাহলে আমেরিকায় কী ঘটবে? কেউ কেউ বলছেন, অতীতে এরকম ঘটেছিল, তা স্বাভাবিকভাবেই মীমাংসা হয়েছে। পরাজিত প্রেসিডেন্ট গোঁ ধরে বসেছিলেন-তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না।
তার গোঁ ধরাকে প্রশাসন গ্রাহ্য করেনি। তারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। সেইমতো তারা কাজ করেছেন। দিন-তারিখমতো তারা নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেকের ব্যবস্থা করেছেন। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি তাকে শপথ পড়িয়েছেন।
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বিদায়ী প্রেসিডেন্টের বাক্স-প্যাটরা হোয়াইট হাউসের বাইরে রেখে নতুন প্রেসিডেন্টের বাক্স-প্যাটরা ভেতরে নিয়ে এসেছেন। এখানেই পরাজয় মানতে অনিচ্ছুক পুরনো প্রেসিডেন্টের খেল খতম হয়ে গিয়েছিল।
অনেকে মনে করেন, এবার ট্রাম্পের খেলায়ও তা-ই ঘটবে। আমেরিকার প্রশাসন তাদের সংবিধান মেনে কাজ করবেন। ট্রাম্প কলার খোসার মতো বাইরে বিসর্জিত হবেন।
সংবিধান মেনে চলা প্রশাসন ও জুডিশিয়ারির সাহায্যে জো বাইডেন যথাসময়ে যথানিয়মে হোয়াইট হাউসে অবস্থান নেবেন। গত শনিবারের গার্ডিয়ানেও আভাস দেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে। ট্রাম্প পরাজয় মানার ব্যাপারে আগের চেয়ে নরম হয়েছেন। (Trump comes closer to admitting defeat) কিন্তু একই খবরের অন্যত্র যা বলা হয়েছে, তাতে মনে হয় না ট্রাম্প সহজে হাল ছাড়বেন।
একজন সাংবাদিক যখন হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারিকে বলেন, ‘২০ জানুয়ারি জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট পদে অভিষেক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প যদি উপস্থিত না থাকেন, সেটা হবে দুঃখের ব্যাপার।’ তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, ‘I think the president will attend his own inauguration. He would have to be there, in fact.’- আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট তার নিজস্ব অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন, নয় কি?
হোয়াইট হাউসের বর্তমান (ট্রাম্পের) প্রেস সেক্রেটারির মন্তব্য সত্য হলে নিজের অভিষেকের নামে ট্রাম্প আরও কী করেন তা ভেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই শঙ্কিত।
ভয় পাওয়ার আরও কারণ, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তামাশার সুরে বলেছেন, There will be a smooth transition to a second Trump-administration.-দ্বিতীয় ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অত্যন্ত সহজভাবে হবে। কথাটা তামাশা, না এ উক্তির মধ্যে কোনো গভীর চক্রান্তের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে, তা ভেবে মার্কিন রাজনীতিকদেরও অনেকে শঙ্কিত।
ট্রাম্পের বা ট্রাম্পের সহকর্মীদের কথাবার্তায় কিছু মার্কিন রাজনীতিক মনে করেন, ট্রাম্প যে পরাজয় স্বীকার করতে চাইছেন না, এর পেছনে তার মানসিক ভীতি কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট পদে বসে তিনি যে অন্যায়, অনাচার, সরকারি অর্থের অপচয়, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি করেছেন, ক্ষমতা হারানোর পর সে জন্য তাকে শত শত মামলার সম্মুখীন হতে হবে।
এটা তিনি জানেন। তাই নির্বাচনকালেই তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে পরাজিত হলে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।’
এখন তিনি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু দেশ থেকে পালানোর সুযোগ তার নেই। হয়তো হোয়াইট হাউস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মামলায় তাকে আদালতে হাজির হওয়ার পরোয়ানা জারি হতে পারে। পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করতে পারে। কিন্তু যতদিন তিনি প্রেসিডেন্ট আছেন, ততদিন তার কোনো ভয় নেই।
ওয়াশিংটনের গুজব, ট্রাম্প চাচ্ছেন এ ব্যাপারে তিনি জো বাইডেনের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সঙ্গে একটা দর কষাকষি করবেন। নতুন প্রেসিডেন্ট তাকে ক্ষমতায় থাকাকালে সব অপরাধের জন্য ইমিউনিটি দেবেন। বিনিময়ে তিনি বাইডেনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেবেন।
ওয়াশিংটনের এই গুজবটি কতটা সত্য, এখনও জানা যায়নি। তবে এই গুজবের সঙ্গে আরও একটা গুজব যুক্ত হয়েছে, হোয়াইট হাউসে অবশিষ্ট আড়াই মাস থাকার সময়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রোকালমেশন দ্বারা সেলফ ইমিউনিটি তিনি ঘোষণা করবেন। ট্রাম্প যদি তা করেন, তাহলেও মার্কিন গণতন্ত্র দারুণ আঘাত থেকে বেঁচে যাবে।
আর ট্রাম্পের এ কথিত পরিকল্পনা যদি সফল না হয়, তাহলে ডেসপারেট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন কিছু করতে পারেন, যা শুধু আমেরিকার গণতন্ত্রকে নয়, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই গুরুতর আঘাত হানবে।
গার্ডিয়ানে কলামিস্ট জনাথন ফ্রিন্ডল্যান্ড আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ট্রাম্প আমেরিকায় কোনো কনভেনশনাল ক্যু ঘটাবেন না; কিন্তু এমন ক্যু ঘটাবেন, যাতে আমেরিকা কালো ও সাদা হিসেবে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে।
এই বিভক্তিটা তিনি মানসিকভাবে ইতোমধ্যে ঘটাতে পেরেছেন। সাদা ভোটারদের অধিকাংশের মনে তিনি এই ভয় ঢোকাতে পেরেছেন, আমেরিকায় কালোরা এতই শক্তিশালী হয়েছে, ওবামার মতো বারবার তারা কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী করে আনতে পারবে।
আমেরিকায় সাদাদের একচ্ছত্র রাজত্ব আর থাকবে না। কালোদের মনেও তিনি এই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন, সাদা আমেরিকায় কোনোদিন তাদের নাগরিক সমঅধিকার জুটবে না। তাদের ‘টমকাকার কুটিরের’ বাসিন্দা হয়েই থাকতে হবে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্টরা তাদের রক্ত ও শ্রম দিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে গেছেন। সেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্যের ধ্বংস সাধন করে যাবেন ট্রাম্প।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট যে আড়াই মাস হোয়াইট হাউসে থাকেন, ততদিন কোনো নতুন অথবা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। তিনি দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে যান। কিন্তু ট্রাম্পের কার্যকলাপ থেকে অনেকেই সন্দেহ করেন, তার মনে অন্য অভিসন্ধি রয়েছে।
তিনি প্রেসিডেন্ট-ইলেকট বাইডেনের করোনা প্রতিরোধের ব্যবস্থায় বাধাদান করেছেন। যে করোনায় আড়াই লাখ আমেরিকানের মৃত্যু হয়েছে, তাকে রোখার কাজকে বাইডেন প্রায়োরিটি দিয়েছেন। তিনি প্রাথমিকভাবে আমেরিকায় লকডাউন ঘোষণা করতে চান। বাধা দিচ্ছেন ট্রাম্প।
তিনি নিউইয়র্কের ওষুধ কোম্পানি ফাইজার যে ভ্যাকসিন বের করেছে, তিনি তার গুণগান করে লকডাউন আরোপে বাধা দিয়ে চলেছেন।
গত শনিবারের গার্ডিয়ানে জনাথন ফ্রিন্ডল্যান্ড লিখেছেন, ট্রাম্প হঠাৎ কেন প্রতিরক্ষা বিভাগের (পেন্টাগন) সিভিলিয়ান নেতৃত্বকে বরখাস্ত করে আলট্রা লয়ালিস্টদের সেখানে বসালেন?
প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারকে বরখাস্ত করার কারণ কি এই যে, ওয়াশিংটনে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময় ট্রাম্প চেয়েছিলেন মিলিটারি মোতায়েন করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করতে, এসপার তাতে রাজি হননি? তাহলে তিনি এখন কী চান? তিনি ক্ষমতা না ছাড়তে চাইলে দেশে যে গণবিক্ষোভ হবে, তা দমনের জন্য মিলিটারি মোতায়েনের মতলব তার আছে কি? সে জন্য তার পছন্দের লয়াল কোনো ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে বসাতে চান বা বসিয়েছেন।
দেশে জরুরি অবস্থা সৃষ্টি করেও ট্রাম্প জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণ বিলম্বিত অথবা বানচাল করার চেষ্টা করতে পারেন। ফ্রিন্ডল্যান্ড আশঙ্কা করেন, তিনি আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে সারা মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আগুন জ্বালাতে পারেন।
অথবা সহসা ইরান আক্রমণ দ্বারা আমেরিকাকে নতুন একটি যুদ্ধে জড়িয়ে তার ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত অথবা অনিশ্চিত করে তুলতে পারেন। আমাদের প্রার্থনা, ফ্রিন্ডল্যান্ডের এই আশঙ্কা যেন সত্য না হয়। আমেরিকার গণতন্ত্র যে শক্ত সাংবিধানিক কাঠামোর ওপর স্থাপিত, তা ভাঙার সাধ্য এবং দুঃসাহস যেন ট্রাম্পের না হয়।
বাংলাদেশেও ট্রাম্পের অনুসারী একটি দল আছে। দেশে নির্বাচন হলেই এবং তারা পরাজিত হলেই রব তোলেন নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। ট্রাম্প এবং তার দল যেমন বর্ণবাদী, বাংলাদেশের এ দল এবং তার নেতারা তেমনি সাম্প্রদায়িক।
এদেরও নীলনকশা দেশে কী করে সন্ত্রাস দ্বারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করা যায়। এদের ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ করার জন্য বাংলাদেশেও অটুট জাতীয় ঐক্য দরকার।
Leave a Reply