দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের দেশ বসনিয়ার একটি জঙ্গলে আটকেপড়া বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের কয়েকশ শরণার্থী অবশেষে মানবিক সহায়তা পেয়েছেন। উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের ধনী কোনো দেশে ঢুকতে এসব শরণার্থী অবৈধ পথে বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী ভেলিকা ক্লাদুসার জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সেখানে খোলা আকাশের নিচে শীতের মধ্যে খাদ্য ও পানীয় ছাড়া কয়েক মাস ধরে মানবেতর জীবন পার করছিলেন তারা। অবশেষে গত সোমবার তাদের মধ্যে খাবার ও স্লিপিং ব্যাগ বিতরণ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম। এই শরণার্থীদের নিয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে একাধিক
প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইইউ ও আইওএম অন্তত ৬০০ শরণার্থীকে সহায়তার ব্যবস্থা করল। যদিও এ মানুষদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা এখনো অজানা।
জঙ্গলের মধ্যে আটকে থাকা এই শরণার্থীরা কেমন আছেন তা নিয়ে তাদের সঙ্গে গত রবিবার কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম ও অনুপম দেব কানুনজ্ঞ। নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে এসব শরণার্থী আহ্বান জানিয়েছেন, কেউ যেন এভাবে বিদেশে আসার কথা চিন্তাও না করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় প্রতিদিনই দালালদের মাধ্যমে বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পাড়ি দিতে দলে দলে রওনা হন বসনিয়ায় থাকা বিভিন্ন দেশের শরণার্থীরা। তারা একে বলেন, ‘গেম মারা’। কখনো হেঁটে, কখনো বাসে চড়ে, কখনো ট্যাক্সিতে তাদের দালালরা সীমান্তের আশপাশে নিয়ে নামিয়ে দেন। এরপর তাদের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিতে হয়।
বাংলাদেশি অলিউর রহমান ১৩তম বারের মতো চেষ্টা করছেন সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার। বুশি নামের এক পাকিস্তানি দালালের মাধ্যমে বাসে চড়ে তিনি যাবেন ক্রোয়েশিয়া সীমান্তের পাশে কোনো এক জায়গায়। সেখান থেকে দুই দিন হেঁটে তারা পৌঁছাবেন সীমান্তে। অলিউর জানান, এরই মধ্যে তিনি দুবার ক্রোয়েশিয়া পেরিয়ে স্লোভেনিয়াতে পৌঁছালেও, সেখানে ধরা পড়ে আবার ফেরত এসেছেন। ফেরত আসার পথে তাকে শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কেন আবার একই পথে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন, এমন প্রশ্নে অলিউর বলেন, এই গেমের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, প্রায় চার লাখ টাকা। এ জন্য যেতেই হবে।
সবার অবস্থা অবশ্য এক রকম নয়। অনেকেই এখন ফেরত যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করছেন। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেরই খরচ হয়ে গেছে বড় অঙ্কের টাকা। এই আটকেপড়াদের বেশিরভাগই বসনিয়া এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইরান, তুরস্ক, গ্রিস, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া হয়ে। অনেকেরই এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে ১৫-২০ লাখ টাকা। কেউ কেউ এসেছেন ভিটে-মাটি বিক্রি বা বন্ধক রেখে। ফলে দেশে ফিরে এখন চাকরি বা ব্যবসা করে সে ঋণ শোধ করা সম্ভব না বলেও মনে করছেন তারা। সিলেটের ছাতক থেকে আসা সাইফুর রহমান জানান, তার বন্ধুরা এর আগে বেশ কয়েকবার ‘গেমে গিয়ে’ ব্যর্থ এবং বাজেভাবে আহত হয়ে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ইউরোপের নামটাই আসলে আমাদের পাগল করেছে, তাই এই পর্যন্ত আসা। এখন বাংলাদেশে ফেরত যাবেন কিনা, এমন প্রশ্নে সাইফুর বলেন, আমার এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কেউ যদি আমাকে বলে ১০ লাখ টাকা দেব, তাহলে আমি ৫ লাখ টাকা লস দিয়ে হলেও দেশে চলে যাব। যারা বাংলাদেশ বা অন্য যে কোনো জায়গায় মোটামুটি পরিবার চালানোর মতো অর্থ উপার্জনে সক্ষম তারা যেন ভুলেও এই পথে ইউরোপ যাওয়ার জন্য না আসেন সে অনুরোধ জানান সাইফুর।
Leave a Reply