1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ অপরাহ্ন

যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ কার পক্ষ নেবে

কামাল আহমেদ
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্র ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার রূপকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চায়। যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরা স্টোন ভিডিও সংযোগে এক আলোচনায় ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাংবাদিকদের এ কথা বলেছেন। কয়েক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছিলেন। দেশটির প্রতিরক্ষা দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোভিড–১৯ মোকাবিলা ছাড়াও টেলিফোনে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রূপকল্প নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রূপকল্পের মূলে রয়েছে এই অঞ্চলে চীনকে তার প্রভাববলয় তৈরি থেকে নিবৃত্ত করা।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এ পাল্লা দেওয়ার বিষয়টি কীভাবে ক্রমে তীব্র হচ্ছে, তার কিছু অজানা ছবি পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তোলপাড় তোলা সদ্য প্রকাশিত বই রেজ (RAGE)–এ। বইটির লেখক বহুল নন্দিত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডকে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টেলিফোন করে যেসব কথা বলেছিলেন তার একটা বিবরণ বইটিতে আছে। সেখানে কোভিড–১৯ নিয়ে চীনের সঙ্গে টানাপোড়েনের কথা আছে, মহামারির ঝুঁকি কত বড় বলে ধারণা করা হচ্ছিল, সেই কথাও আছে। আর আছে আগের দিন প্রেসিডেন্ট সির সঙ্গে ট্রাম্পের টেলিফোনে কী কথা হয়েছিল তার ভাষ্য। ট্রাম্প এর আগেই ববকে বলেছিলেন যে ‘মেড ইন চায়না–২০২৫’ পরিকল্পনায় চীন উচ্চ প্রযুক্তির ১০টি শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। সেদিন তিনি ববকে জানান যে তিনি সিকে বলেছেন যে এটি তাঁর জন্য খুবই অপমানজনক। তিনি তখন ইতিমধ্যে বাণিজ্যে চীনের কতটা ক্ষতি করতে পেরেছেন, গর্বভরে সে কথা জানান।

ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে সাম্প্রতিক কালে যেসব বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে তাঁরা বৈশ্বিক পরিসরে চীনকেই তাঁদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করছেন। সুতরাং, নতুন যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর আলামত ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, সেই নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পের ভালো-মন্দ আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিস্ময়কর হলেও লক্ষণীয় যে বাংলাদেশের বামপন্থী, মধ্যপন্থী এবং ডানপন্থী, বিশেষত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নীরবতা পালন করে চলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রূপকল্পটা কী? বলা হয় যে এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মূলত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথকে উন্মুক্ত ও নিরাপদ রাখা। এ অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্বের কারণ হচ্ছে বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর বাস এ অঞ্চলের দেশগুলোতে এবং এসব অর্থনীতি উচ্চ ও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী। যুক্তরাষ্ট্রের এ রূপকল্পে ভারতের রয়েছে একটি বিশেষ অবস্থান।

২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ জাস্টারের বক্তব্যে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ভারতকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও তার বাইরেও একটি নেতৃস্থানীয় শক্তির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, এর লক্ষ্য হচ্ছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে, বিশেষভাবে ভারত মহাসাগর ও তার আশপাশে শান্তির প্রতি হুমকির ক্ষেত্রে সফলভাবে সাড়া দেওয়ায় সক্ষম ভারতকে আমাদের সমর্থন অব্যাহত রাখা। তিনি আরও যেসব লক্ষ্যের কথা বলেছেন, সেগুলোর মধ্যে আছে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে একটি মুক্ত ও অবাধ অঞ্চল নিশ্চিত করতে সমুদ্রযান চলাচলের স্বাধীনতা, আকাশপথে বিমান চলাচল এবং বাণিজ্য ও সমুদ্রের অন্যান্য আইনসম্মত ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষা, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসারে সহায়তার কথাও বলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়ে দিল্লি ঢাকাকে কিছু বলেছে কি না, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। কেননা, কোনো পক্ষই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেনি। তবে অপ্রকাশ্য আলোচনায় দিল্লি এমন প্রত্যাশার কথা জানাবে, সেটাই স্বাভাবিক। চীনের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির পটভূমিতে তার সম্ভাবনা যে আরও অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় তাই সাম্প্রতিক চীন-ভারত সামরিক সংঘাতের কথাও উঠে আসছে। ১৮ সেপ্টেম্বর সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির শুনানিতে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডেভিড আর স্টিলওয়েল চীনকে একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তির বদলে একটি বেয়াড়া (আইন না মানা) পান্ডা বলে অভিহিত করেন। সে সময় তিনি বেইজিংয়ের গত কয়েক মাসের আচরণের বিবরণ দিতে গিয়ে ভারতের সীমান্তে সহিংসতা ও দক্ষিণ চীন সাগরে আগ্রাসী তৎপরতার কথা উল্লেখ করেন।

মি. স্টিলওয়েল এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিকৌশলের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বহু বছর ধরে এ ধারণার ভিত্তিতে কাজ করে এসেছে যে নিয়ম বা বিধিভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তিকে সহায়তা করলে দেশটির ভেতরে সংস্কার হবে এবং তা আরও উন্মুক্ত হবে। কিন্তু চীনের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতি ক্ষুদ্র আত্মস্বার্থে পরিচালিত এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের কর্তৃত্ববাদী মূল্যবোধের লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক পরিবেশে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে ও তাকে নতুনভাবে রূপায়িত করার চেষ্টা করছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন যে প্রতিদিন সকালে পররাষ্ট্রনীতির যে নীতিটি নিয়ে তিনি ভাবেন তা হচ্ছে চীন। বস্তুত বেশ কিছুদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও নীতিমালা ঘোষণা করে চলেছে, যেগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে চীন। এগুলোর মধ্যে যেমন আছে চীনা পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ, বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা, নিরাপত্তাঝুঁকির কারণ দেখিয়ে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি হুয়াওয়ের ফাইভ–জি মোবাইল প্রযুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিষেধাজ্ঞা, উই চ্যাটের মতো সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, মানবাধিকারবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা, হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে চীনের দমননীতির পাল্টা ব্যবস্থা ইত্যাদি।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র চীনা ঋণের উচ্চ সুদ এবং বিনিয়োগের সম্ভাব্য রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকির বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসছে। এমনকি তথ্যপ্রবাহ ও প্রচারমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সিনহুয়া, পিপলস ডেইলি, চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে দূতাবাসের অংশ ঘোষণা এবং তাদের জনবলের সীমা বেঁধে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। বেইজিং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালওয়াশিংটন পোস্টসহ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ভিসা বাতিল ও কার্যক্রম সীমিত করার পদক্ষেপ নেওয়ার পাল্টা হিসেবে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট অব ইউএস সেন্টারের ক্ষেত্রেও।

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতাও চলছে জোরেশোরে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানের দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক অগ্রাধিকারের বিষয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সামরিক জোট ন্যাটোর মতো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠনের কথাও বিভিন্ন পরিসরে আলোচিত হচ্ছে। গত সপ্তাহেই মালদ্বীপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি সই করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের রণতরি এবং চীনা নৌবাহিনী বিপজ্জনক শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায় লিপ্ত আছে। সবকিছু মিলিয়ে নতুন শীতল যুদ্ধের কাল যে জোরেশোরেই শুরু হয়েছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট।

বাংলাদেশের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আপাতদৃশ্যে আমরা এখন পর্যন্ত এই নীতিতেই আছি এবং কোনো ধরনের বৈরিতায় জড়াইনি। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছালেও লাদাখে চীন-ভারত সংঘাতের সময়েও আমাদের সেই সমদূরত্ব বজায় থেকেছে। স্বভাবতই ভারত বিষয়টিতে চিন্তিত। সেখানকার পত্রপত্রিকায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিকে বাঁকা চোখেই দেখা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ রকম বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পে অংশ নেওয়ার অনুরোধে বাংলাদেশ কী করবে? রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকেরা কি বিষয়টি নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করবেন?

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com