গত ১৮ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এক অনির্ধারিত ঝটিকা সফরে ঢাকা ভ্রমণ করে গেছেন। তার এই হঠাৎ সফর কূটনৈতিক অঙ্গনে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। তবে সফরের উদ্দেশ্য যাই হোক আমরা বরাবরের মতো এবারো মিষ্টিকথার আকর্ষণীয় কূটনৈতিক বচন শুনেছি। ফলে আমাদের সাধারণ জনগণের মনে প্রশ্ন জেগেছে এই সফরে মিস্টার শ্রিংলার আশাজাগানি কথামালা কি আদৌ বাস্তবায়িত হবে নাকি কূটনৈতিক বচন হিসেবেই থেকে যাবে।
এত গভীর সম্পর্ক বিরাজমান থাকলেও ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব এ ধরনের অস্বাভাবিক সফরের প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে সচেতন মহলে। অনেক প্রকার বিশ্লেষণের অবতারণা হয়েছে। গবেষকরা মনে করেন ‘বাংলাদেশ-ভারত-চীন’ এই তিন দেশের ত্রিকৌণিক সম্পর্কের ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটই এই সফরের পটভূমি রচনা করেছে। প্রকৃতিপক্ষে নিকটাতীতে আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারত এত খারাপ অবস্থায় কখনো নিপতিত হয়নি। তারা বর্তমানে এক ধরনের আঞ্চলিক নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। দীর্ঘ দিন ধরে অঞ্চলে বড় ভাই বা মোড়লসুলভ আচরণের পরিণতিতে ভারত আজ প্রায় বন্ধুহীন। ভারতের জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ সম্প্রতি ‘বিবিসি’ কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীন-ভারত বিরোধ নিয়ে এশিয়ার ছোট দেশগুলো ভেতরে ভৈতরে হয়তো খুশি। তারা মনে করেছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যকে চীন চ্যালেঞ্জ করেছে, ভারতের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে এটা তাদের একটা সুযোগ’ (দৈনিক নয়া দিগন্ত : ২২/০৭/২০২০)।
মার্কিন এক সাময়িকিতে অর্চনা চৌধুরী এবং বিভুদত্ত ওরাধন এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, “মোদির দ্বিতীয় দফা শাসনে ‘কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ এজেন্ডায় প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয়, সন্দেহ, অস্বস্তি ঢুকেছে।” এমন প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক চীনের সাথে সীমান্ত দ্বন্দ্ব ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমরনীতি, নিরাপত্তাসহ সর্বক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের স্বার্থ বা পাওনা আদায় করতে না পারলেও ভারত তাদের চাণক্যনীতিতে তাদের স্বার্থ পুরোটুকু আদায় করতে পারঙ্গম।
কাজেই বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মি. শ্রিংলার অনির্ধারিত ঝটিকা সফরের প্রেক্ষাপট সৃষ্টির উপাদানগুলো হলো : (১) গত মে মাসের প্রথম দিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। (২) গত জুলাই মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন। আবার পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। (৩) পত্রিকার সংবাদ মোতাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার বিগত চার মাস ধরে চেষ্টা করেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি। (৪) চীন শতকরা ৯৭ ভাগ বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ঘোষণা করেছে। (৫) সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের কাজ একটি চীনা কোম্পানি পেয়েছে। (৬) সম্প্রতি চীনের একটি ‘কোভিড-১৯’ বিশেষজ্ঞদল বাংলাদেশ সফর করেছে এবং চীনা ভ্যাকসিনের তৃতীয় দফা পরীক্ষা বাংলাদেশে সম্পন্ন করার চুক্তি হয়েছে। (৭) নয়াদিল্লির জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় হলো তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনার জন্য চীনের প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সংবাদ।
উপরি উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে অত্যন্ত অস্বস্তিকর অবস্থার প্রেক্ষিতেই ভারত আমাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাচ্ছে এবং বরাবরের মতো কথার ফুলঝুরি দিয়ে আমাদেরকে তাদের দিকেই ঝুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। অথচ যুগ যুগ ধরে তারা আমাদেরকে যে কষ্ট, নিপীড়ন, নিগ্রহ, অপমান আর অবহেলা দিয়ে যাচ্ছে তার কোনো সমাধানের কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন-মরণ সমস্যায় পরিণত হলেও তিস্তার পানি ভারত সরিয়ে নিচ্ছে একতরফাভাবে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মানমোহন সিং-এর সফরের সময় তিস্তা চুক্তির দ্বারপ্রান্তে এসেও বিফল হয়েছে। তার পর থেকে ভারতের ‘খুব দ্রুতই হবে তিস্তা চুক্তি’ এই আশ্বাস শুনে এসেছি। কিন্তু আজ ২০২০ সালে এসেও সেই ‘দ্রুততর’ সময়ের দেখা আমরা পেলাম না। অথচ আমরা তাদের সব চাহিদা বাধ্য প্রতিবেশীর মতো পূরণ করেছি। ফেনী নদীর পানি দিয়েছি। তাদেরকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট দিচ্ছি। তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের গ্রেফতারকৃত ‘উলফা’ নেতাদেরকে হস্তান্তর করেছি। এর ফলে তাদের বিশাল এক মাথাব্যথার উপশম হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে নিয়োজিত অর্থ, জনবল, সশস্ত্রবাহিনীসহ সবই তারা এখন তাদের নিরবচ্ছিন্ন জাতীয় উন্নয়নে নিয়োজিত করতে পারছে। কিন্তু ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ) নিয়মিতভাবে আমাদের নিরস্ত্র বাংলাদেশদের হত্যা করে যাচ্ছে।
ভারতের ওই সম্পর্কোন্নয়নের মধুর তৎপরতার সময় সীমান্তে বাংলাদেশী নিরীহ মানুষকে হত্য করা হয়েছে। এভাবে আমাদের সীমান্তবর্তী দরিদ্র জনগোষ্ঠী ‘বিএসএফ’ এর তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। গত ১১ জুলাই সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে, ১৬ আগস্ট (মি. শ্রিংলার সফরের দুই দিন আগে) কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী এবং গ্রামবাসীদের দ্বারা দুই বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। এরই মধ্যে আসামের করিমগঞ্জে তিন বাংলাদেশী নিহত হয়। এমনকি প্রকাশ্যে দিবালোকে বাংলাদেশী কন্যা ফেলানীকে ‘বিএসএফ’ হত্যা করলেও আজ পর্যন্ত তার সুবিচার হয়নি। গত সাত মাসে এ ধরনের সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিগত ২০১৯ সালে মোট ৪৩ জন বাংলাদেশী সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
ভারতীয় মিডিয়াও সমানতালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। সম্প্রতি চীন যখন আমাদেরকে ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ঘোষণা করেছে তখন ভারতের বিভিন্ন বড় বড় মিডিয়া আউটলেট এটাকে অত্যন্ত ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বর্ণনা করেছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সম্পর্ককে তারা খয়রাতি হিসেবে প্রচার করেছে। আবার অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় একটি নিউজ পোর্টাল মেজর সিনহাকে মিয়ানমারের জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আরসা’ এর প্রশিক্ষণ ও মাদক চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে।
অন্য দিকে গত ৬ জুলাই বিএসএফ ‘সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ এর ডিআইজি এস এস গুলেরিয়া বিজিবি এবং বাংলাদেশের কোরবানি সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর ও অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বিজিবিকে গরু চোরাচালানের মদদদাতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কোরবানির উদ্দেশ্যে গরু নেয়াকে তিনি পশু নির্যাতনের শামিল বলে মন্তব্য করেন। আর এভাবে কোরবানি হবে কি না তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। একজন সামরিক কর্মকর্তার পক্ষে এ ধরনের অন্য দেশের বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং অন্য দেশের ধর্মের বিষয়ে বিবৃতি দেয়াটা চরম অসৌজন্যমূলক এবং অপ্রতিবেশীসুলভ অন্যায় আচরণ। যদিও পরবর্তীতে বিজিবি থেকে পাল্টা বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যু এখন আমাদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ভারতকে পাশে পাওয়ার সবচেয়ে বড় দাবিদার। কিন্তু উল্টো ভারত মিয়ানমারের পাশেই প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছে আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাসবাণী শুনিয়েছে শুধু। আবার মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ভূমিতে উন্নয়নের কাজে ভারত অর্থ বিনিয়োগ করছে যেটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থেই করছে। তবে মি. শ্রিংলা সফরের শেষে আবার আশ্বাস দিয়ে গেছেন যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে ভারত বর্তমান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, ভারতের এই সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশেরও সমর্থন ছিল। তিনি আরো আশ্বাস দিয়েছেন যে, সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে বিএসএফ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হবে।
মোদ্দাকথা হলো মি. শ্রিংলা একটি জটিল আঞ্চলিক সমীকরণের সময় বাংলাদেশে এসেছেন দুই দেশের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক আরো গভীর করার উদ্দেশ্য নিয়ে। এই সম্পর্কটা এখন আঞ্চলিক ভূরাজনীতি, অর্থনীতি আর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। আসলে বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হয় বহুপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিমূলে পারস্পরিক লাভ-লোকসানের নিরিখে। ‘প্রতিবেশীই প্রথম’, ‘বাংলাদেশই আগে’ ইত্যাদি মিষ্টিমধুর কথায় কূটনৈতিক সম্পর্কের আবরণ রক্ষ করা যায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রের আচরণটাই রচনা করবে সুপ্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক। কারণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা শুধুই দুটো সরকারের মধ্যে নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ছাপিয়ে এই সম্পর্ক প্রসারিত হয় দুই দেশের জনগণের মধ্যে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
Leave a Reply