২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গত ১৪ বছরে দেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। কাউকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকে আবার কাউকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের পরিবারের পক্ষ থেকে।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো, লাশ উদ্ধার ও ফিরে আসা মানুষের সংখ্যা ২২৪। অবশিষ্ট ৩৮০ জনের কোনো হদিস নেই দীর্ঘদিনেও। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানে না কেউ। এমন প্রেক্ষাপটে আজ গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে পালিত হয় আন্তর্জাতিক দিবস। এ দিবসটি ঘিরে বিভিন্ন সংগঠন পালন করে নানা কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে যোগ দেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা। তারা এখনো তাদের প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন।
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে সেলিম রেজা পিন্টুকে তুলে নিয়ে যায় কতিপয় অস্ত্রধারী। এ সময় তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কালো কাচের একটি সিলভার রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় পিন্টুকে। তিনি ছিলেন তৎকালে সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি। নিখোঁজের পর থেকে পিন্টুর সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কাছে ধরনা দেয় তার পরিবার। কিন্তু কোনো ফল পায়নি। এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গুনছে পরিবারটি।
এ ঘটনায় ২০১৫ সালে রাজধানীর পল্লবী থানায় পিন্টুর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আদালতে মামলা করা হয়। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে সেলিম রেজা পিন্টুকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ পায়। কিন্তু কারা এ ঘটনায় জড়িত, তা শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
সেলিম রেজা পিন্টুর বড় বোন রেহেনা বানু মুন্নি আমাদের সময়কে বলেন, আমার ভাই সন্ত্রাসী কিংবা ইয়াবা কারবারি না। তাকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে ছিল অসুস্থ। তিনি বলেন, আমার ভাই বেঁচে নেই, সেটি আমরা বিশ^াস করি না। আমৃত্যু বিশ^াস করে যাব, আমার ভাই একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর এবং স্বজনদের বরাত দিয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছেন। অন্যদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কারও কাছে।
২০১১ সালের ২২ জুলাই উত্তরার তুরাগ থানা এলাকা থেকে মাহবুবুর রহমান শিপন নামে এক ব্যবসায়ীকে দুই ব্যক্তি মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যান। এরপর থেকে আর তার খোঁজ মেলেনি। মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী আমাদের সময়কে জানান, তাদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। মাহবুবুর রহমান গুম হওয়ার সময় তার ছোট মেয়ের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। শুরুতে বাবার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি বুঝতে না পারলেও একটু বড় হওয়ার পর থেকে প্রশ্ন করা শুরু করে ছোট্ট মেয়েটি। তার বাবা কোথায়, কবে ফিরবে- এসব প্রশ্ন ওর প্রতিদিনের। এরই মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণিপড়–য়া ছোট মেয়েকে নিয়ে মাহবুবুর রহমানের স্ত্রীর চলছে জীবন-সংগ্রাম। এ বিষয়ে মামলা করতে গেলে থানাপুলিশ ফিরিয়ে দেয় তাদের, জানান তিনি। বলেন, র্যাব কার্যালয়ে ঘুরেও কোনো সমাধান পাননি। ছোট্ট মেয়েটি মনে করে, তার বাবা একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আমাদের সময়কে বলেন, প্রায় ৭শ মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। কিছু মানুষের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে এটা ঘটছে। এ নিয়ে আমরা প্রশ্ন করলে সরকার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সরকারের ভাষ্য, গুম বলে কোনো শব্দ নেই। তাদের কাছে বিভিন্ন মানুষ টাকা পাবে। তাই তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা নিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানো এবং হাস্যরসের কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা তাদের নাম বলে তুলে নেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এসব মানুষের বিষয়ে এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যাতে করে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারে। উল্টো মনে করার কারণ আছে যে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কোনো গোষ্ঠী অথবা চেইন অব কমান্ডের ত্রুটি অথবা রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার কারণে প্রতিনিয়ত এসব কা- ঘটছে। তাদের চিহ্নিতকরণ অথবা আটক করার কোনো তৎপরতা নেই রাষ্ট্রের তরফে। গুম একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর অবসান দরকার। গুম যারা হয়েছেন, তারা কে, কোথায় আছেনÑ তা বের করতে আস্থাভাজন একটি তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান প্রতিরোধ দিবসের প্রাক্কালে গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে অনতিবিলম্বে খুঁজে বের করা, প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। একই সঙ্গে গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে এই মানবাধিকার সংগঠনটি।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ ২০০২ সাল থেকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ শুরু করে। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। ইংরেজিতে এর নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এ আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়। তখন থেকে ৩০ আগস্টকে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
Leave a Reply