(ক) পৃথিবীর মোট পাট উৎপাদনের বেশির ভাগই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। সর্বোপরি বাংলাদেশের পাটের আঁশের শক্তি, পাটের রং পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বলেই বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে।
ঔপনিবেশিকতাবাদোত্তর কালে বাজার নিয়ন্ত্রণের এক নব্য ঔপনিবেশিকতার শিকার বাংলাদেশ, বদলেছে চামড়ার রং, মুখের ভাষা আর হরফ দেবনাগরী।
(গ) বাংলাদেশের কি সক্ষমতা নেই এই রপ্তানি করা পাট প্রক্রিয়াজাত করার?
আদমজী-উত্তর বাংলাদেশের পাট কারখানাগুলো বছরে ১২ লাখ টন কাঁচা পাট প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা রাখে, কিন্তু সমস্যাটা বিপণনে।
ন্যূনতম ১৩৯ ডলার, সর্বোচ্চ ৩৯৮ ডলার অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপ করে বসে আছে বাংলাদেশের ওপর। ফলে কাঁচা পাট ছাড়া কোনোভাবেই পাটজাত কোনো পণ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়।
পদক্ষেপ-২ : শস্য, বিশেষত কফি, কোকো, কাজু, আখরোট, পেস্তা উৎপাদনকারী সব দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর পাটজাত পণ্যের বিশেষ রোড শো আয়োজন করা দরকার; যেখান থেকে পণ্য উৎপাদক মিলগুলোর নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ই–মেইল এবং উৎপাদিত পণ্যের তালিকা পুস্তিকাকারে অংশগ্রহণকারী আমদানিকারকদের দেওয়া হবে। এই আয়োজনের খরচ জোগাবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, কৃষি ও পাট মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে। এই দূতাবাসগুলো সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘দ্বিপক্ষীয় কৃষিজাত পণ্য কর মওকুফ বা হ্রাস’ চুক্তি সম্পাদন করে পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পথ সুগমে ব্যবস্থা করতে পারে।
পদক্ষেপ-৩ : পাটের ওপর ধার্যকৃত টনপ্রতি ২৫০ ডলার ট্যাক্স, যা সরকারের তহবিলে জমা হয়েছে তার অর্ধেক (১২৫ ডলার) ‘উৎপাদন প্রণোদনা’ হিসেবে অর্থবছর শেষে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রপ্তানি অনুযায়ী বণ্টন করা এবং বাকি ১২৫ ডলারের ৫০ ডলার দিয়ে পাট চাষিদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বীজবণ্টনের ব্যবস্থা করা হলে পাট উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যা মনিটর করবেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
পাট উৎপাদন বৃদ্ধি সাপেক্ষে সেরা তিনজন কৃষি কর্মকর্তাকে ‘বর্ষসেরা’ পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে, যার উল্লেখ তাঁর এসিআরে থাকবে।
পদক্ষেপ-৪ : পাট রপ্তানির ২৫০ ডলারের মধ্যে এখনো বাকি আছে টনপ্রতি ৭৫ ডলার, যা খরচ করা হবে কর্মী প্রশিক্ষণে। গোটা বাংলাদেশের সব কটি জেলায় যুব উন্নয়ন একাডেমি রয়েছে বিশাল জায়গা নিয়ে। চীনের যান্ত্রিক সহযোগিতা নিয়ে এই প্রতিটি সেন্টারকে পাটজাত পণ্য উৎপাদনের প্রশিক্ষণশালায় পরিণত করে স্বল্পশিক্ষিত, পিছিয়ে থাকা মানুষকে তিন মাসে প্রশিক্ষিত করে পাটশিল্পে নিয়োগ করা যায়।
কী লাভ হবে বাংলাদেশের? পাটশিল্পে (সুতা ও ব্যাগ) প্রতি টন পাট প্রক্রিয়াজাত করতে গড়ে ২৩ জন শ্রমিকের দরকার হয়।
বাংলাদেশে প্রতিবছর পাট উৎপাদিত হয় ২০ লাখ টন, অর্থাৎ উৎপাদিত পাট প্রক্রিয়াজাত করতে গেলে শুধু শ্রমিকই লাগবে ৪৬ লাখ! তদারককারী, কর্মকর্তাসহ কর্মসংস্থান হবে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের। উপরন্তু গড়ে টনপ্রতি এক হাজার ২০০ ডলার মূল্য ধরলে বাংলাদেশের উপার্জন হবে বছরে ২৪০ কোটি ডলার। উপার্জিত এই বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই বাংলাদেশের, ব্যাক টু ব্যাক এলসির মূল্য পরিশোধের দায় নেই।
যেই মুহূর্তে কাঁচা পাট রপ্তানিতে ২৫০ ডলার শুল্ক বসানো হবে এবং সমুদ্রবন্দর দিয়েই শুধু কাঁচা পাট রপ্তানি করা বাধ্যতামূলক করা হবে, সেই মুহূর্ত থেকেই বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। অবশ্যম্ভাবীরূপেই। ফলে বিশ্বের পাটপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণের কিছুটা ফিরে পাবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে কোকো, কফি, কাজু, আখরোট, পেস্তা উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যদি বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি শুল্ক হ্রাসের চুক্তিটি করতে সক্ষম হয়, বিশ্ববাজার খুলে যাবে পাটপণ্য উৎপাদকদের জন্য।
সেই সঙ্গে উৎপাদন প্রণোদনা, পাট-কৃষকের প্রণোদনা, সেরা কৃষি কর্মকর্তার প্রতিযোগিতা পাট চাষ বৃদ্ধি এবং পাটপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। বাজার তো তৈরিই আছে!
বর্তমানের কর্মীসংকট মোকাবেলায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর তৈরি রেখেছে প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী। অন্যদিকে সৌদি আরবও তৈরি ১০ বছর ধরেই এই পাটপণ্য উৎপাদন খাতে বিপুল বিনিয়োগে, যা বিগত সরকার স্থগিত রেখেছে। এই সব পদক্ষেপ এক করলে বিশ্বের পাটপণ্যের বাজার সম্পূর্ণভাবেই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আর কে না জানে, বাজার নিয়ন্ত্রণকারী দেশ সর্বোচ্চ সুবিধা এবং মূল্য বরাবরই আদায় করে নেয়।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি খাত হিসেবে বাংলাদেশ কি পারবে পাটকে প্রণিধানযোগ্য করতে, নাকি আর সব কিছুর মতোই এই দুই বিলিয়ন ডলারের বাজারও হারাবে বাংলাদেশ?
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
Leave a Reply