চরম উত্তেজনার মধ্যেই ঘোষণা এসেছিল, আকস্মিক। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ঘণ্টা কয়েক পরই লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু একদিনের মাথায় যুদ্ধবিরতি মান্য করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে দুই দেশের মধ্যে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকÑ সব ধরনের উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা খুলে দিয়েছে পাকিস্তান। ভারতের শ্রীনগরে দোকানপাট খুলে গেছে। সীমান্তের দুই পারের কাশ্মীরেই স্বস্তিতে ঘরে ফিরছে পরিবারগুলো। কিন্তু, আল জাজিরার এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ বন্দুক নীরব, তবে অবিশ^াসের সুর পরস্পরের কণ্ঠে। এ কারণে, আপাতত সংঘাত বন্ধ হলেও যুদ্ধবিরতি কতটা কার্যকরভাবে দীর্ঘস্থায়ী হবে, এ নিয়ে সামরিক বিশ্লেষকরা সন্দিহান। ভারত ও পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলোর অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকেও দুই দেশের কর্তাদের পরস্পর বিদ্বেষী পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকির খবর পাওয়া গেছে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলার জেরে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত শুরু হয়। ৭ মে পাকিস্তানে ‘সিঁদুর’ নামের অভিযান চালায় ভারত। ১০ মে ভারতে পাল্টা অভিযান চালায় পাকিস্তান, যার নাম ‘বুনইয়ান-উন-মারসুস’ তথা ‘দুর্ভেদ্য দেওয়াল’। এদিনই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই দেশ তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতে সম্মত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে প্রথম ঘোষণা দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর ওই দিন বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৫টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে, তিন ঘণ্টা পর নয়াদিল্লি প্রথম অভিযোগ তোলে, পাকিস্তান শর্ত লঙ্ঘন করে ভারতের কাশ্মীরে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইসলামাবাদও পরে একই
ধরনের অভিযোগ তোলে।
রবিবার দুই দেশের মধ্যে আর কোনো ধরনের সামরিক সংঘাতের খবর বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে বিবিসি ও আল জাজিরা। ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তান বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ (পিএএ) জানায়, দেশটির আকাশসীমা এখন উন্মুক্ত রয়েছে। পিএএর একজন মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের সব বিমানবন্দর উড়োজাহাজের স্বাভাবিক চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এদিকে এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরের দিন রবিবার সকাল থেকে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরের সড়কে স্বস্তির ভাব দেখা গেছে। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট। মানুষ নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজে ফিরছেন। যদিও অনেকে বলছেন, তারা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য সতর্ক আছেন। যেমনÑ শ্রীনগরের হায়দারপোরা এলাকার মুদি দোকানি মোহাম্মদ আনাস বলেন, ‘আমরা সতর্ক আছি। কেন না এ যুদ্ধবিরতি কত দিন টিকবে, সেটা কেউ জানে না।’
তবে, দুই দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ এবং কাশ্মীরের দীর্ঘদিনের শাসন ও বঞ্চনার ইতিহাস টেনে সামরিক বিশ্লেষকরা যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ভারত নিজেকে উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে দেখে এবং দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ব্যাপারে রক্ষণশীল। অন্যদিকে, পাকিস্তান বিদেশি সাহায্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় দেশটি যুদ্ধবিরতিতে স্বাগত জানায়।
চার দিন ধরে একে অপরের ভূখণ্ডে সরাসরি সামরিক হামলার পর অনেকে আশঙ্কা করছিলেন, কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে এই হামলা-পাল্টা হামলা চলতেই থাকবে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
ওয়াশিংটন ডিসির হাডসন ইনস্টিটিউটের ইন্ডিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার রিসার্চ ফেলো ড. অপর্ণা পান্ডে বলেছেন, ভারত কখনোই কোনো বিবাদে মধ্যস্থতা মেনে নেয়নি, তা ভারত-পাকিস্তান হোক বা ভারত-চীন, বা অন্য কোনো। অন্যদিকে, পাকিস্তান সব সময় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা চেয়েছে, তাই তারা এর প্রশংসা করবে। তিনি যোগ করেন, কাশ্মীর বিবাদ নিয়ে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আলোচনা ও সমাধানের এটাই ‘একমাত্র উপায়।’
যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিশে^র অন্তত ৩০টি দেশ। তবে, পাকিস্তানের সামরিক আচরণের দিকে ইঙ্গিত করে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, এই যুদ্ধবিরতি আসলে অস্থায়ী সমাধান।
এই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত কীভাবে হলো, এ নিয়েও দুই দেশের মধ্যে কৃতিত্বের কাজিয়া চলছে। ভারত বলছে, ইসলামাবাদকে ট্রাম্প প্রশাসন বাধ্য করেছে যেন তারা দ্রুত সামরিক হটলাইন সচল করে নয়াদিল্লিতে ফোন করে যুদ্ধ থামানোর কথা বলে। আবার পাকিস্তান বলছে, ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে মোদিকে যুদ্ধ বন্ধে চাপ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ভারত ও পাকিস্তান আপাতত যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে সরে এলেও যুদ্ধবিরতি টিকবে কিনা, তা দেখার বিষয়। পর্যটকদের ওপর হামলার পর উভয় পক্ষ আরও কিছু প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে ছিল ভিসা স্থগিত করা, বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা এবং ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পানিবণ্টন চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া। এসব পদক্ষেপ প্রত্যাহার হবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান জোর দিয়ে বলেছেন, এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে উপমহাদেশ ‘যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে।’ তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি, যতক্ষণ পর্যন্ত তা বহাল থাকে, এমনকি কিছু মাত্রায় লঙ্ঘনের পরও, কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির অবসান ঘটিয়েছে।’
কুগেলম্যান আরও বলেন, ‘এটি একটি অত্যন্ত কঠিন যুদ্ধবিরতি হতে চলেছে। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠার সময় এটি খুব দ্রুত সম্পন্ন করা হয়েছে।’
একজন কাশ্মীরি রাজনীতি বিশ্লেষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। যুদ্ধ হোক, ভারত হোক বা পাকিস্তান, সীমান্তের মানুষ, কাশ্মীরি ও পাঞ্জাবিরা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রাণ হারাচ্ছে। আশা করি, এই উন্মাদনা এখানেই থামবে।’
Leave a Reply