ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ইস্যুভিত্তিক, জনজীবন ঘনিষ্ঠ ও যথার্থ অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে মাঠে নামতে চায় বিএনপি। এজন্য দলটি আগেই নিজ থেকে না নেমে সমমনা দলগুলোর মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু করতে চায়। ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি এবং মাঠে চাপ তৈরিই থাকবে এসব কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। নির্বাচনের প্রস্তুতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং অন্যান্য ইস্যুতে কর্মসূচি দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ছক কষছে।
জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধিতার সুযোগ খুঁজবে না বিএনপি। কর্মসূচি নিয়ে নানা হিসাবনিকাশ চলছে। এরই অংশ হিসেবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতারা নানা বিষয়ে প্রকাশ্যে মত দিলেও মাঠে নামেননি।
সূত্র বলছে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম, জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে কর্মসূচির ধরন সম্পর্কে জানা যাবে। আগামীকাল ৭ এপ্রিল স্থায়ী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে ঈদের দিন রাতে ভার্চুয়ালি দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছাবিনিময় করেন এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি শক্তি ক্ষমতায় থাকার জন্য নতুন নতুন পন্থা বের করছে; কিন্তু ফ্যাসিস্টরা দাঁড়াতে পারেনি। এই শক্তিও যাতে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত রয়েছে। ১৬-১৭ বছর ধরে যে আকাঙ্ক্ষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য লড়েছি, সেই আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সংসদ সরকার পরিচালিত হবে। যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। জনগণ যদি সেটি নাই পেল, তাহলে তো আমাদের কর্মসূচিতে যেতেই হবে।’
তিনি জানান, ‘একদিকে আমরা সরকারকে সমর্থন দিয়েছি। আরেক দিকে যদি তারা নির্বাচন দিতে দেরি করে, তাহলে জনগণের চাহিদা পূরণ হবে না। তাই বিএনপি কর্মসূচির বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে। তবে এটা নিশ্চিত, নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হলে আমরা আবার মাঠের কর্মসূচিতে যাব।’
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দিতে দলটির অভ্যন্তরে ও সমমনাদের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে। তবে, সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি কর্মসূচি দেওয়ার পরিবর্তে সমাবেশের মাধ্যমে আন্দোলন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি, সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনের দাবিতে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
নেতাদের মতে, ‘খুব দেখেশুনে বিএনপিকে পা ফেলতে হচ্ছে। কারণ সরকারের ভেতরের একটি পক্ষ, জামায়াতসহ বিভিন্ন শক্তি বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করছে। আবার ড. ইউনূসের ভারত-সংক্রান্ত কার্যক্রম সরকারের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব জনগণের মধ্যে রয়েছে। রোজা ও ঈদে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তাই কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপিকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।’
বিএনপির সঙ্গে বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জানান, ‘নির্বাচনের জন্য আমাদের মাঠের কর্মসূচিতে যাওয়া হবে অনাকাক্সিক্ষত। তবে যদি সরকার নির্বাচন অনিশ্চিত রাখে, তাহলে মাঠে কর্মসূচিতে যাওয়ার বিকল্পও থাকবে না। আমরা যারা বিএনপির জোটসঙ্গী, জোটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমাদের কর্মসূচি হবে।’
লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক
কর্মসূচির ধরন নিয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন সমমনা দলের সঙ্গে বৈঠক করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গতকাল শনিবার রাতে গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
‘অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবে একমত’ জানিয়ে বিএনপির অনলাইন ক্যাম্পেইন
এদিকে গতকাল দলটির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে জানানো হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে বিএনপি। এটি জানিয়ে দলটির পক্ষ থেকে অনলাইন ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে। সংস্কার কমিশনের কতগুলো সংস্কারের সঙ্গে একমত পোষণ করা হয়েছে, কতগুলোর বিষয়ে আংশিক কিংবা নীতিগতভাবে একমত আর কতগুলো প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি, তা ক্যাম্পেইনে তুলে ধরা হচ্ছে।
সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজের এক পোস্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের একটি ছাড়া বাকি সবগুলো প্রস্তাবে একমত পোষণ করেছে বিএনপি। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ৮৭ শতাংশের সঙ্গে পুরোপুরি কিংবা নীতিগতভাবে একমত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে দলটি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ৫৪ শতাংশ সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপির ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার কমিশনের দেওয়া বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকারসহ ৫৬ শতাংশ প্রস্তাবে বিএনপির মত রয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের উচ্চাভিলাষী, পরীক্ষামূলক ও নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্নকারী এমন প্রস্তাবগুলোর বিরুদ্ধে বিএনপি দ্বিতীয়বারের মতো অবস্থান নিয়েছে।
সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে সার্বিকভাবে বলা হয়, অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি একমত। দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব এমন ও বাস্তবমুখী সব প্রস্তাবে বিএনপি একমত। তবে, উচ্চাভিলাষী ও পরীক্ষামূলক প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে অধিকতর আলোচনা প্রয়োজন। এ ছাড়া নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে কিংবা সরকারের অচলাবস্থা সৃষ্টি করে এবং নাগরিক সেবা রুদ্ধ করে এমন প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে বিএনপির দ্বিমত রয়েছে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচার বিভাগ সংস্কারের ২৩ সুপারিশের মধ্যে ২০টিতে বিএনপি একমত। দুদক সংস্কারের ২০ সুপারিশের ১৯টিতেই বিএনপি একমত। জনপ্রশাসনের সংস্কারের ২৬ প্রস্তাবের অর্ধেকের বেশি বিষয়ে বিএনপি একমত, বাকিগুলোর বিষয়ে দলীয় মন্তব্য রয়েছে। আর সংসদে দুজন ডেপুটি স্পিকারের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত করতে বিএনপি ২০০১-এ নির্বাচনে বিজয়ের পরই করেছিল। কিন্তু তখনকার বিরোধী দল সে প্রস্তাব আমলে নেয়নি।
মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে বলা হয়, দলের সংস্কারবিষয়ক ইতিবাচক মনোভাব এই পরিসংখ্যান দিয়েই বোঝা যায়।
Leave a Reply