রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও সাদা পোশাকে (ইউনিফর্ম ছাড়া) পুলিশের তৎপরতা কমছে না। শীর্ষ পর্যায় থেকে নিষেধ থাকার পরও সাদা পোশাকে চলছে পুলিশের অভিযান। আসামি ধরার নামে পুলিশের কিছু সদস্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই অভিযান চালাচ্ছে। বিনা ওয়ারেন্টে (গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই) বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হানা দিচ্ছে পুলিশ। সাদা পোশাকে অভিযানে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও থানা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা কৌশলে অহরহ এমন অভিযানে নামছে বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
দু’দিন আগে কুমিল্লায় যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সাদা পোশাকে কয়েকজন থাকার বিষয়ে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। এ ঘটনায় দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরির পর পুলিশও বিষয়টি আমলে নিয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির বিতর্কিত ও সমালোচিত ৫৪ ধারায় বিনা ওয়ারেন্টে আটকের ঘটনাও ঘটছে।
এর আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছর ধরে পুলিশের বিরুদ্ধে সাদা পোশাকে ও ৫৪ ধারায় আটকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগ থাকলেও কোনো প্রতিকার হয়নি। উচ্চতর আদালতের নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে একইভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও সাদা পোশাকে পুলিশি অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশির ক্ষেত্রে ব্যক্তির মর্যাদা এবং সম্মানরক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে হয়রানি, শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগ্রহের ঘটনাও আছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক এক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) দেশ রূপান্তরকে বলেন, থানা পুলিশের বাইরে সিআইডি, ডিবি ও এসবি সাদা পোশাকে কাজ করে। অনেক সময় অপরাধী গ্রেপ্তার করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে সাদা পোশাকে কাজ করতে হয়। কিন্তু আটকের সময় পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়। যাকে আটক করা হবে তার কাছে পরিচয় জানাতে হবে। আইন মেনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করতে হবে। আসলে সাদা পোশাকের অপব্যবহার হয় বলেই সাদা পোশাক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পুলিশকে আইন মেনে কাজ করতে হবে। গোয়েন্দাদের পাশাপাশি থানা পুলিশ এসব কাজ করছে বেশি। গত সরকারের আমলে সাদা পোশাকে অভিযান বেশি হয়ে আসছিল। বর্তমানে তা কিছুটা কমলেও সাদা পোশাকে অভিযান অব্যাহত আছে।
সাবেক এ আইজিপি আরও বলেন, সাদা পোশাকে নজরদারি করতেই পারে। কিন্তু কাউকে আটক করলে তার কাছে অবশ্যই পরিচয় দিতে হবে। আইডি কার্ড দেখাতে হবে। তবে পোশাক পরেই গ্রেপ্তার বা অভিযান চালানো উত্তম। তা না হলে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাবে। পরিচয় গোপন করে পুলিশের কোনো বিভাগের সদস্যই আটক বা গ্রেপ্তার করতে বা অভিযান চালাতে পারবেন না। আর যারা সাদা পোশাকে কাজ করেন তাদের সবার যার যার বিভাগের নিজস্ব লোগো দেওয়া জ্যাকেট আছে, তা ব্যবহার করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, সাদা পোশাকে আটকের সময় আটককারীরা পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোবাস রিকুইজিশন করে ব্যবহার করা হয় গ্রেপ্তারের কাজে। এ কারণে কারা আটক করল বা আটক করে কোথায় নেওয়া হলো, তা জানা অনেক সময়ই কঠিন হয়ে পড়ে। আটকের কথা পরে জানা গেলেও দেখা যায় আইন লঙ্ঘন করে তাদের হেফাজতে রাখা হয়।
গত সরকারের আমলে যাদের বিভিন্ন সময়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল বা গুম করা হয়েছে তাদের, অধিকাংশকেই সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়েছিল। তুলে নেওয়ার সময় ডিবি, র্যাব, সিআইডি বা সামরিক গোয়েন্দাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো পরিচয় দেয়নি। ফলে কারা নিয়েছে, কেন নিয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে তখন জানা সম্ভব হয়নি। অনেকেরটা পরেও জানা যায়নি। এ ধরনের অভিযানকারীরা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহার করত, যাতে তাদের চিহ্নিত করা না যায়।
গুম কমিশনে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে এ ধরনের গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে ১ হাজার ৬৭৬টি। তার মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে কমিশন। যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ এখনো নিখোঁজ।
গত ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অফিস পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, সিভিল পোশাকে (ইউনিফর্ম ছাড়া) কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের নিজ বিভাগের নিজস্ব লোগো দেওয়া জ্যাকেট অবশ্যই পরিধান করতে হবে। এ ছাড়া পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। আইনের বাইরে তারা কোনো কাজ করতে পারবেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পরও পুলিশে কিছু অনিয়ম থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে সাদা পোশাকে পুলিশের আটক করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। মাস দেড়েক আগে ঢাকার মতিঝিল ও বাড্ডা এলাকা থেকে সাদা পোশাকে আমার দুই স্বজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। দিনভর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে তাদের খোঁজ নেওয়া হয়। কিন্তু পাওয়া যায়নি। পরে গভীর রাতে তাদের থানায় পাওয়া যায়। তাদের ৫৪ ধারায় আটক করে পুলিশ। পরে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।’
মানবাধিকারকর্মীরা জানান, ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এক রায়ে হাইকোর্ট ৫৪ ধারার প্রয়োগে কারও সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতা না করা, আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পরিচয় দেওয়া, কাউকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ না দেওয়া, রিমান্ডে নির্যাতন না করা এবং ধারা দুটি সংশোধনের তাগিদসহ ১৫টি নির্দেশনা দেয়। ২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকে। ওই বছরের ১০ নভেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য নিয়ে বলা হয়, নাগরিকের সম্মান রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উঁচুমানের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এ ছাড়া সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিকের অধিকারের সুরক্ষার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু এ নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন থানার সাদা পোশাকের টিমের বিরুদ্ধে নানা অপরাধে জড়ানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আইজিপি কমপ্লেইন সেলে প্রতিদিনই এ ধরনের অভিযোগ জমা পড়ছে। আবার সাদা পোশাকে অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকারও হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। অথচ উচ্চ আদালত ও ডিএমপির পক্ষ থেকে ২০১৪ সাল থেকে সাদা পোশাকে অভিযান চালানোয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এদিকে সাদা পোশাকে পুলিশি তৎপরতার সুযোগ নিচ্ছে পেশাদার অপরাধীরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরাও।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, থানার পুলিশের সিভিল টিম গঠনের বা সাদা পোশাকে অভিযান চালানোর এবং আটক করার আইনগত ভিত্তি নেই। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম) বা পরিচালনা কাঠামোতে (পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল) থানার পুলিশের সিভিল টিম বলতে কিছু নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও থানা এলাকায় নজরদারির জন্য ওসি নিজ থানার আয়তন অনুযায়ী সিভিল টিম গঠন করেন। তারা রাতের বেলায় বেশি তৎপর থাকেন এবং সন্দেহভাজনদের আটকের নামে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাদা পোশাকে পুলিশ অভিযান চালাতে পারবে না। কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশের কোনো সদস্য যদি কোনো ধরনের অপকর্ম করে তাকে আইনের আওতায় আনা হয়। কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না এবং ভবিষ্যতেও হবে না।’
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অভিযানের নামে কোনো নিরীহ লোকজনকে যাতে পুলিশ না ধরে সেদিকেও বিশেষ নজরদারি রয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হয় না। অভিযোগ পেলেই আমরা মনিটরিং করে থাকি। সাদা পোশাকে একমাত্র স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন চলাফেরা করে। ডিবি ও সিআইডি অভিযান চালানোর সময় তারা ডিবি ও সিআইডির মনোগ্রামযুক্ত জ্যাকেট বা কটি ব্যবহার করেন। এর বাইরে সাদা পোশাকে অভিযান চালানোর এখতিয়ার নেই। তারপরও যদি থানা পুলিশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কুমিল্লায় যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামকে আটকের সময় সাদা পোশাকের কয়েকজন ছিল বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে জেলা পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, এ অভিযানে পুলিশ যায়নি। অন্য কোনো বাহিনী বা সংস্থার কেউ গিয়েছিল কি না, সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও সাদা পোশাকে কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
Leave a Reply