দেশের পোশাক খাতে গত ছয় মাসে অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। এ সময়ে ৬৮টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা এবং কিছু কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করায় চাকরি হারান তারা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ, আর্থিক সংকট, ঋণখেলাপি হয়ে পড়া, কাজের অর্ডার না পাওয়া, মামলাজনিত কারণে মালিকদের অনুপস্থিতি, অনেক মালিকের জেলে থাকা, পণ্যের দাম কমে যাওয়া, সংকটকালে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পারা ইত্যাদি কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং বিনিয়োগের অভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার মধ্যেই বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নতুন করে বেকার পয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা দ্রুত ব্যবসার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং রুগ্ন শিল্পগুলো রক্ষায় সরকারকে সহযোগিতার পরামর্শ দিয়েছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কর্মহীন শ্রমিকদের দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে সমাজে অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যেতে পারে।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই ও গাজীপুরে গত ছয় মাসে ৬৮টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টি স্থায়ী ও ১০টি অস্থায়ী ভিত্তিতে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ছয়টি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে কেয়া গ্রুপ। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের। এর বাইরে ধুঁকতে থাকা অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই করছে।
জানা গেছে, বন্ধ হয়ে পড়া ৬৮ কারখানার মধ্যে ৫১টি গাজীপুরে এবং ১৭টি ঢাকার সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে। এসব কারখানায় কাজ করতেন প্রায় অর্ধলক্ষ শ্রমিক। বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে প্রায়ই বন্ধ থাকছে সড়ক-মহাসড়ক। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। আন্দোলনরত শ্রমিকদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা চালু করতে ঋণসহ বিভিন্ন সহায়তা চাইছে কোনো কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ। স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বন্ধ তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে রয়েছে গাজীপুর মহানগরীর সারাব এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি, টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার টিএমএস
অ্যাপারেলস, চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল, মাহমুদ জিনস ও হার্ডি টু এক্সেল, কোনাবাড়ীর পলিকন লিমিটেড, অ্যাপারেল প্লাস, টিআরজেড ও দি ডেল্টা নিট।
বেক্সিমকো গ্রুপের ১৬টি কারখানা লে-অফ ঘোষণা করায় প্রায় ৪২ হাজার কর্মী চাকরি হারান। চলতি মাসে তারা বেতন পেলেও ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের বেতনও বন্ধ হয়ে যাবে। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বেক্সিমকোর শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। তারা বলেন, এই ৪২ হাজার মানুষের সঙ্গে বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আশপাশের দোকানদার, অটোরিকশাচালক ও স্কুল-মাদ্রাসা মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে মানবেতর জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে তাদের এবং তখন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার নতুন সংকটও তৈরি হতে পারে। বেক্সিমকোর ৪২ হাজার কর্মজীবীর মধ্যে প্রায় ২ হাজার প্রতিবন্ধী, শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এবং ৫ হাজারের মতো ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি রয়েছেন।
গত আগস্টে গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই শিল্পগোষ্ঠী সংকটে পড়ে। বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টা ছিলেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত নভেম্বর পর্যন্ত বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি খেলাপি হয়ে পড়েছে। আর্থিক বিবরণীতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেক্সিমকো ৩৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। আগের অর্থবছরের মুনাফা হয়েছিল ৭১০ কোটি টাকা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারল্য সংকট, কার্যাদেশ কমে যাওয়া ও বকেয়া মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত নভেম্বরে শিল্পগোষ্ঠীটি পরিচালনার জন্য রিসিভার নিয়োগ করে। এরপর থেকে জনতা ব্যাংক শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য শিল্পগোষ্ঠীটিকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। এর পরিমাণ প্রতি মাসে প্রায় ৬০ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমিকদের বেতন দিতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ অবদান রাখা এই শিল্পে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে রপ্তানি বাজারে ভাগ বসাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলো। এতে কারখানার মালিক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। এর মধ্যে নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়ে। এসব শ্রমিকের দ্রুত কর্মসংস্থানে নিয়োজিত করা প্রয়োজন। তবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। পাশাপাশি রুগ্ন শিল্পগুলোকে সচল করতে সরকারের সহযোগিতাও প্রয়োজন।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, পরিবারের একমাত্র উর্পাজন করা ব্যক্তি যখন বেকার হয়ে পড়েন, তখন তিনি জমানো টাকা খরচ করেন। সেই টাকা ফুরিয়ে গেলে ধার-কর্জ করে জীবিকা নির্বাহ করে। যখন সেই পথও বন্ধ হয়ে যায় তখন জীবিকা নির্বাহের জন্য চুরি, ডাকাতি শুরু করে। এর মধ্যে অনেকে মাদকসহ নানা ধরনের অনিয়ন্ত্রণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
তৌহিদুল হক বলেন, কর্মহীন মানুষগুলো যখন অপরাধে জড়িয়ে যায় এর দায় শুধু তার একার নয়। শক্ত আইন না থাকার কারণে-অকারণে কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। এজন্য শিল্প-কারখানায় সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সবার আগে পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা প্রয়োজন। তিনি বলেন, অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে। তিনি বলেন, পোশাক শিল্প দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকটের মধ্যে রয়েছে। অনেক কারখানা রুগ্ন হয়ে গেছে। আর্থিক সংকটের কারণে কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। অনেকে বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাই করেছেন। তাই রুগ্ন কারখানাগুলোকে সচল করতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারের সহযোগিতা পেলে কারখানাগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, কারখানাগুলোতে প্রতিনিয়ত কর্মী ছাঁটাই চলছে। অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ অকারণে ছাঁটাই করে। এসব ছাঁটাই বন্ধ করা উচিত। তিনি বলেন, বেকার শ্রমিকদের জীবন, সংসার বাঁচানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এসব কর্মীদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা প্রয়োজন।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, জুলাই আন্দোলনে শ্রমিকরা জীবন দিয়েছে, কিন্তু সুফল পায়নি। জুলাইয়ের পরে শ্রমিকের বুকে গুলি চালানো হয়েছে। মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। হাজার কর্মী বেকার হয়ে গেছেন। তাদের পক্ষে জীবিকা নির্বাহ করা দায় হয়ে পড়েছে। এসব শ্রমিকের পক্ষে কেউ নেই। বর্তমান সরকারও এখন মালিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। এটা খুবই দুঃখজনক।
Leave a Reply